আপডেট : ২২ এপ্রিল, ২০২৪ ১৩:২১

দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা কর্মকাণ্ড আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে

অনলাইন ডেস্ক
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা কর্মকাণ্ড আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে
৫ মার্চ, ২০২৪-এ তোলা এই ছবিটিতে সাংবাদিকদের দেখা যাচ্ছে যে বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরে দ্বিতীয় থমাস শোলে সরবরাহ মিশনের সময় একটি চীন কোস্ট গার্ড জাহাজ (আর) বিআরপি সিন্দানগানের সামনে দিয়ে যাত্রা করছে।

দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা কর্মকাণ্ড আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি ওই অঞ্চলের বিরোধপূর্ণ জলসীমায় ফিলিপাইনি সেনাদের বহনকারী নৌবহরকে লক্ষ্য করে চীনা জাহাজ জলকামান ছুড়েছে বলে অভিযোগের পর এ নিয়ে সরব হয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

এদিকে ফিলিপাইনের সামুদ্রিক অভিযানে হস্তক্ষেপ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট না করতে এবং কৌশলগত জলসীমায় ‘দেশটির বিপজ্জনক ও অস্থিতিশীল আচরণ’ বন্ধ করতে চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ফিলিপাইন রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের সামরিকীকরণ এবং ভীতি প্রদর্শন কার্যক্রমের বিরোধিতা করে গ্রুপ অফ সেভেনের (G7) বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়েছে। সম্প্রতি একটি বৈঠকের বিবৃতিতে, G7 পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দক্ষিণ চীন সাগরের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং জোর দিয়েছিলেন যে কৌশলগত জলপথে চীনের বিস্তৃত সামুদ্রিক দাবির কোনও আইনি ভিত্তি নেই। G7 কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে গঠিত।

পশ্চিমা কর্মকর্তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক মহলের বাধা উপেক্ষা করে দক্ষিণ চীন সাগরে ‘ভূমি’ দখলদারিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে বেইজিং। ইতোমধ্যে তারা প্রবালপ্রাচীরে ঘেরা দ্বীপের এলাকা কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দখল করেছে। দ্বীপগুলোতে তারা সামরিকীকরণ করে বন্দর, রানওয়ে, হেলিপ্যাড ও বিমানঘাঁটির মতো অন্য অবকাঠামো স্থাপন করেছে। সেখানে যুদ্ধবিমান নামানোরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত কয়েকটি স্যাটেলাইট ছবিতে সেসব চিত্র উঠে এসেছে।

দক্ষিণ চীন সাগরের ওই বিতর্কিত অঞ্চলকে (স্প্রাটলি) নিজেদের বলে দাবি করে ব্রুনেই, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দেনেশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশও। কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চল ঘিরে তাদের মধ্যেও উত্তেজনা বিরাজ করছে। চীন তাদের দাবি মোকাবেলায় ওই ঘাঁটিগুলো বানিয়েছে। কারণ, দক্ষিণ চীন সাগরের ওই অংশেই রয়েছে তেল ও গ্যাসের আধার। স্প্রাটলি ছাড়াও পারাসেল দ্বীপেও চীন তার আধিপত্য কায়েম করেছে।

চীন যতই দাবি করুক, দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের অধিকার সিংহভাগ। তবে ২০১৬ সালে হেগের আদালত তাদের সেই অধিকারকে সমর্থন দেয়নি। ২০১৩ সালে ফিলিপাইনের করা ওই মামলার রায়ে আদালত বলেছিল, চীন যে নাইন ড্যাশ লাইনের ঐতিহাসিক দাবি করে, তার আইনি কোনো ভিত্তি নেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপগুলো দখলে নিয়েছিল জাপান। ওই যুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর ১৯৪৩ ও ১৯৪৫ সালে দ্বীপগুলো চীনের দখলে যায়। ১৯৪৭ সালে চীনের জাতীয়তাবাদী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫৯ দ্বীপ, ক্ষুদ্রদ্বীপ ও বালুচর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের আওতাধীন করে নেয়। সেসময় কোনো পক্ষ আপত্তি করেনি। এরপর থেকে দক্ষিণ চীন সাগর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীনকে ঠেকাতে মার্কিন কৌশলগুলো অকার্যকর। কারণ, এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। চীনের বিআরআই প্রজেক্টের শুরু এই দক্ষিণ চীন সাগর থেকেই। সেখানে ওয়াশিংটনের চীন বিরুদ্ধ নীতি বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব।

টোকিওভিত্তিক সাসাকাওয়া পিস ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো বনজি ওহারা বলেছেন, প্রান্তিক সমুদ্র চীনের নিরাপত্তার চাবিকাঠি। বেইজিং মূলত তিনটি কারণে দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য চায়।

প্রথমত, চীনা পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সাবমেরিনের কৌশলগত টহলের জন্য এই সাগর গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পারমাণবিক প্রতিরোধ ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশে চীনকে এই সাগর দখলে রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ চীন সাগর চীনের জন্য একটি ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ হিসেবে কাজ করবে। এটি চীনের মূল ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার ঝুঁকি কমাবে।

তৃতীয়ত, চীনের নৌ পরিবহনের জন্য এই সমুদ্রপথ প্রয়োজন। বিশ্ব সামুদ্রিক বাণিজ্যের অন্তত এক তৃতীয়াংশ দক্ষিণ চীন সাগরে পরিচালিত হয়। বলা হয়, এর তলদেশে বিশাল তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত রয়েছে। এটি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মাছ ধরার জায়গা হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চীন স্বীকার করে, এই সাগর ঘিরে সমস্যা রয়েছে এবং যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবেলা করতেও প্রস্তুত তারা। তবে তাদের ভয় হলো, যদি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা প্রশান্ত মহাসাগর, দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগর হয়ে বেইজিংয়ের ওপর আক্রমণ করতে আসে।

সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষ দুই সামরিক বাহিনী (চীন-যুক্তরাষ্ট্র) দক্ষিণ চীন সাগর এবং বিশেষ করে তাইওয়ানে ‘অস্থিতিশীল’ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। চীন অভিযোগ করে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি তৈরি করছে।

এরমধ্যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলা করতে অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ (কোয়াড) গঠন করেছে। এ জোটের দেশগুলোর মধ্যে নিয়মিত তথ্য বিনিময় ও সামরিক মহড়া পরিচালিত হচ্ছে।

দক্ষিণ চীন ইস্যুতে যেসব দেশের স্বার্থ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। চীনঘনিষ্ট এই ‘সংবেদনশীল’ অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ হিসেবে দেখে। কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌ বাহিনী রয়েছে ওয়াশিংটনের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত মে মাসে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ) চালু করেন। ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন এই অর্থনৈতিক কাঠামোতে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানসহ ১৪টি দেশ রয়েছে। মূলত চীনের তৎপরতা ঠেকাতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র নৌ বহর নিয়ে এই রুটে মহড়াও দেয়। তবে চীন বরাবরই তাদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাক না গলাতে সতর্ক করে আসছে। গত ৩০ ডিসেম্বর দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক যুদ্ধবিমানের কাছাকাছি চলে এসেছিল মার্কিন যুদ্ধবিমান। পরে দুদেশই এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেয়।

 

 

উপরে