মুমুর্ষূ অর্থনীতিতে সৌদির জীবনমানে আসছে আমূল পরিবর্তন

সৌদি আরবের বাজেট ও অর্থনীতি মূলত জ্বালানি তেল নির্ভর। বছরের পর বছর ধরে এ খাত থেকে আসা রাজস্ব দিয়ে বাজেটে নানা খাতে সরকার ভর্তুকি দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় সৌদি সরকার বাজেট ভর্তুকি যোগান দিতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। তাই ২০১৬ সালের বাজেটে বেশ কিছু ভর্তুকি ও প্রণোদনা কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
পাশাপাশি সরকারের ব্যয় ১৪ শতাংশ সংকোচন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এরপরও বাজেটে যা ঘাটতি হয়েছে তা সৌদি আরবের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
চলতি বছর সৌদি সরকারের বাজেট ঘাটতি প্রায় ৩৬৭ বিলিয়ন সৌদি রিয়াল (৯৮ বিলিয়ন ডলার), যা মোট জিডিপি’র ১৫ শতাংশ। আগামী বছরের বাজেটে ঘাটতি থাকবে ৮৭ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের শেষ নাগাদ তেল বিক্রি থেকে সৌদি আরব মোট ১৬২ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব অর্জন করবে। যা ২০০৯ সালের পর সর্বনিম্ন।
ফলে মুমুর্ষূ অর্থনীতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে সাধারণ সৌদিদের জীবনে।
তেল সাগরে ডুবে থেকে বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত সৌদিদের জন্য জ্বালানী তেলের দাম কমার ধাক্কাটা লেগেছে বেশ জোরে। সৌদির রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মোহাম্মদ হাদুদের ভাষ্যে, দেশে সংকটের সুর স্পষ্ট। ৩০ বছর বয়সী এই শিক্ষক জানান,‘অনেক কিছুতে পরিবর্তন আসছে। অধিংকাশ তরুণ এই হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না’।
তেল সামাজ্যের পতনের সুর বইছে সৌদি রাজপরিবার থেকে শুরু করে সাধারণ সৌদি পরিবারগুলোতে। সবচেয়ে হতাশায় আছে দেশটির তরুণ সমাজ। সৌদির মোট জনসংখ্যার ৪০ ভাগই তরুণ। বিদেশী শ্রম নির্ভর দেশটিতে অভ্যন্তরীণ বেকারত্বও প্রকট। এরপরও এতোদিন এই বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীকে টাকার জন্য ভাবতে হয়নি। ফ্রিতে মিলেছে স্বাস্থ্য সেবা, জ্বালানী তেল পেয়েছে নামমাত্র মূল্যে। তবে এখন সব কিছুতেই অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকার।
তবে এই সংকট সৌদিদের এনে দিচ্ছে বিকল্প চিন্তা, পুরোনো কট্টর ব্যবস্থায় পরিবর্তনের পথও সুগম করছে। শরিয়া আইন নির্ভর দেশটিতে ধর্মীয় অনুশাসন রক্ষায় নিয়োজিত সম্ভ্রান্ত পুলিশ বাহিনীর খরচের লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে। ‘যেভাবে ইচ্ছা খরচ করো’ ব্যাপারটি এখন জবাবদিহির আওতায় আসছে। বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক হই-হুল্লোর প্রবণতা থাকলেও এতোদিন এই পুলিশ বাহিনীই ছিলো অবিবাহিত প্রেমিক যুগলের জন্য যমদূত। ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা ভালোবাসা দিবসে গোলাপ দেখলেই তেড়ে আসা এই পুলিশকে এবার নমনীয় হতেই হচ্ছে, খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে পশ্চিমা নীতির সঙ্গে।
অচল প্রায় অর্থনীতিকে চালাতে ‘নারীরা কেনো চাকরি করবে’ নীতি থেকেও বেরিয়ে আসছে সৌদি। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। কয়েক বছর আগের সৌদির সঙ্গে এ পরিবর্তন যেনো রাত-দিনের পার্থক্য।
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে সৌদিদের সন্দেহ প্রবণতাও কমতে শুরু করেছে। পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ নিতে সামাজিক মাধ্যমে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় এখন সৌদি তরুণরা। রাজপরিবারের চোখ রাঙানিও এক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে। অনেক তরুণ ই-কমার্সে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার রপ্ত করে রোজগারের পথ খুঁজে নিচ্ছে। সৌদি জনপরিসরেও আসছে পরিবর্তন।
আগে সৌদি রেস্টুরেন্টগুলোকে কারাগারের সঙ্গে তুলনা করা হতো। খাবার টেবিলগুলো ঘিরে রাখতো পর্দা, পাছে কেউ পরিবারের মেয়েদের দেখে ফেলে! এমনকি মেয়েরা পুরুষ অভিভাবক ছাড়া রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতে পারবেন না এমন নোটিশ ঝুলতো দরজায়। এখন সেখানেই তরুণীরা দল বেঁধে আসছেন, তুলছেন সেলফি।
রেস্টুরেন্টগুলোতে গান বাজছে, টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে কার্টুন ছবি। সব সৌদিই যে পরিবর্তন চান, ব্যাপারটি আবার সেরকমও নয়।
বিডিনিউজ৩৬৫ডটকম/এসএম