
এক গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে। ঘাড়ের পেছন দিক থেকে চাপাতির কোপে মাথা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে নিভে গেছে জীবন প্রদীপ। এমন করে একে একে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জন খুন। কিন্তু তাতেও রক্তের হোলিখেলা থামায়নি জঙ্গিরূপী খুনিরা। যাকে গুলি করা হয়েছে তাকে আবার কোপানো হয়েছে। লাশ খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে খুনিদের চরম আক্রোশে। গুলশানের ওকিচেন রেস্টুরেন্ট ও হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীরা বিদেশি নাগরিকদের এমন নির্মমভাবেই হত্যা করেছে। নিহতদের একজনের শরীরে ৩০ থেকে ৪০টি কোপের চিহ্ন পাওয়া গেছে। জঙ্গিদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কয়েকজনের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ময়নাতদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
হামলাকারীদের এমন বীভৎস হত্যাযজ্ঞের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, দু-তিনজন বিদেশিকে গলা কেটে হত্যার পরই কয়েকজন চিৎকার করে ওঠেন। তাঁদের দুজন জঙ্গিদের প্রতিরোধের চেষ্টাও করেন। এ সময় জঙ্গিরা গুলি চালায়। পরে গুলিতে নিহত বিদেশিদের লাশে কোপায় খুনিরা। পরে আবার গলা কেটে হত্যা শুরু করে তারা। দূর থেকে হত্যাযজ্ঞ দেখে প্রাণে বেঁচে আসা ওই বাঙালির বর্ণনার সঙ্গে সুরতহাল প্রতিবেদন এবং ময়নাতদন্তের প্রাথমিক তথ্যের মিল রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নিহতদের ভিসেরা পরীক্ষার জন্য আলামত পাঠানো হয়েছে। এই পরীক্ষা শেষ হলেই জঙ্গিদের হাতে নিহত ২০ জনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এদিকে নিহত পাঁচ জঙ্গি কিভাবে এত হিংস্র খুনি হলো তা জানার জন্যও চলছে নানা পরীক্ষা। পাশাপাশি ডিএনএ পরীক্ষার নমুনাও পাঠানো হয়েছে। এসব পরীক্ষায় নিহত জঙ্গিদের ‘ক্যাপ্টাগন’ জাতীয় উদ্দীপক ওষুধ সেবন করানো হয়েছে কি না তাও জানা যাবে।
অন্যদিকে গুলশান হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে গতকাল পর্যন্ত উল্লেখযোগ অগ্রগতি হয়নি। তবে তদন্তকারীরা বলছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন। এসব তথ্য নিয়ে ফরেনসিক, সাইবার ও ম্যানুয়াল তদন্ত চলছে। ঘটনার পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহভাজন কয়েকজনের তালিকাও তৈরি করেছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
গুলশান হামলায় নিহতদের লাশের ময়নাতদন্ত হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। তবে এই ময়নাতদন্তকারী দলের সমন্বয়ক ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘নিহত ২০ জনকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অবিন্তা কবির ও আরেকজনকে ভারি অস্ত্রের আঘাত এবং অন্য সাতজনকে হত্যার আগে গুলি করা হয়। আর অবিন্তা কবির ও অন্য একজন ছাড়া বাকি সবারই গলাকাটা ছিল। গুলি পাওয়া যায়নি ১১ জনের শরীরে।’ সোহেল মাহমুদ আরো জানান, নিহত সাতজনের দেহে আটটি গুলি পাওয়া গেছে। অবিন্তা কবির এবং একজন জাপানি নাগরিকের মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়। সাত বিদেশি নাগরিককে পেছন দিক থেকে মাথায় গুলি করা হয়। এদের মধ্যে একজন বাদে সবার শরীরে কোপানোর চিহ্ন রয়েছে। অনেকের একই জায়গায় বারবার কোপানো হয়েছে। একজন ছাড়া গুলিতে নিহত বাকিদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় হামলাকারীসহ নিহত মোট ২৬ জনের শরীর থেকে টিস্যু ও চুল সংগ্রহ করা হয়েছে। পাঁচ জঙ্গি নেশা জাতীয় কোনো দ্রব্য গ্রহণ করেছিল কি না তা জানতে তাদের দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের পাকস্থলী থেকে সংগ্রহ করা আলামত ভিসেরা পরীক্ষার জন্য মহাখালীতে পাঠানো হয়। সোহেল মাহমুদ বলেন, ভিসেরা পরীক্ষার রিপোর্ট এলে আগামী সাত দিনের মধ্যে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়া যেতে পারে।
ময়নাতদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিহতদের মধ্যে নারীদেরই বেশি জখম করে দুর্বৃত্তরা। ১০ নারীর মধ্যে ভারতীয় তরুণী তারুশি জৈনের শরীরে ৩০ থেকে ৪০টি জখম করা হয়। বাংলাদেশি নাগরিক ফারাজ হোসেনের গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর হাতে ও মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বাংলাদেশি নারী ইশরাত আখন্দ ও অবিন্তা কবিরের শরীরে কোপানোর একাধিক চিহ্ন ও মাথায় জখম ছিল। জঙ্গিদের হামলায় নিহত ডিবির সহকারী কমিশনার রবিউল করিমের বুকের ডান পাশে স্প্লিন্টার ঢুকে গেছে। বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন খানের গলায় স্প্লিন্টার ঢুকেছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তাঁদের দুজনের মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা বলছেন, ১ জুলাই রেস্টুরেন্টে হামলার পর থেকে রাত ১২টার মধ্যে ২০ জনকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। হামলাকারী ছয় জঙ্গি মারা যায় ওই ঘটনার সাত-আট ঘণ্টা পর।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হত্যার নৃশংসতা ভয়াবহ রকমের দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়েছে হামলাকারীরা স্বাভাবিক মানসিকতায় ছিল না। কারণ আইএসসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা এ ধরনের হত্যার আগে ক্যাপ্টাগন ও এমফিটামিনসহ (বাংলাদেশে ইয়াবা যা দিয়ে তৈরি) কিছু পিল ব্যবহার করে। তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভিসেরা পরীক্ষার আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রত্যেক লাশের সঙ্গেই মেঝেতে রক্তের মোটা স্তর পড়ে ছিল। নিহতদের গলা ছাড়া ঘাড়, কাঁধ, হাত ও বুকেও জখমের চিহ্ন ছিল।
বিদেশি নাগরিকদের নির্মমভাবে গুলি ও কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য দূর থেকে দেখেছেন এমন দুজন উদ্ধার করা ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের একজন হামলার বর্ণনা দিতে রাজি হননি। অন্যজন পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দু-তিনজন বিদেশিকে গলাকেটে হত্যা করে জঙ্গিরা। এরপর হৈচৈ করে ওঠেন জিম্মি কয়েক বিদেশি। তাঁদের কয়েকজন জঙ্গিদের জাপটে ধরে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। এ সময় জঙ্গিরা নির্বিচারে গুলি চালায়। এই গুলিতে কয়েকজন লুটিয়ে পড়লে অন্যরা আর কথা বলারও সুযোগ পায়নি। এ সময় কয়েকজনকে প্রাণভিক্ষা চাইতে দেখেন ওই প্রত্যক্ষদর্শী। পরে নিহতদের লাশে কোপায় দুই জঙ্গি। জঙ্গিদের তিনজনের হাতে রাইফেল ও দুজনের হাতে বড় ছোরা ও চাপাতি ছিল।
গতকাল সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, নৃশংস হামলা বা ভয়াবহতা যাই হোক না কেন তা তাত্ক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্তে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। নৃশংসতা ও রক্তপাত করার নির্দেশনা যে তাদের প্রতি ছিল তা স্পষ্ট। পূর্বাপর ঘটনা ও আলামত মিলিয়ে এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, দৃশ্যমান অগ্রগতি না হলেও মামলার তদন্তে অনেক তথ্য এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছে। বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় সমন্বিত তদন্ত চলছে। এর পেছনে যারা আছে তারা শনাক্ত হয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা। জানতে চাইলে সিটিটিসি ইউনিটের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘আজ পর্যন্ত আমরা আইটি সাইট নিয়ে কাজ করছি। এরপর আগ্নেয়াস্ত্রের আলামতগুলো ব্যালাস্টিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে। অন্যান্য আলামতের রিপোর্টও সংগ্রহ করা হবে।’
প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই রাতে গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর রোডে অবস্থিত ওকিচেন রেস্টুরেন্ট ও হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা ২০ জনকে জিম্মি করার পর হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে জাপানি সাতজন, ইতালির ৯ জন ও একজন ভারতীয় নাগরিক। এ ছাড়া আরো তিনজন বাংলাদেশিকে এ সময় হত্যা করা হয়। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে মারা গেছেন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরের দিন সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ড’ অভিযানে মারা গেছে ছয় জঙ্গি। সূত্র : কালের কণ্ঠ
বিডিটাইমস৩৬৫ডটকম/আরকে