ভারত বয়কট! কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা | BD Times365 ভারত বয়কট! কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা | BdTimes365
logo
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ২৩:২১
ভারত বয়কট! কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা
সিদরাতুল মুনতাহা বর্ণ

ভারত বয়কট! কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা

ভারত ও বাংলাদেশ – এই দুই দেশের সরকার তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে যতই ‘সোনালি অধ্যায়’ বলে বর্ণনা করুক, দুই দেশেই একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ যে তাদের প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেন না এ কথা গোপন নয়। এখন সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই সেটা দিনের মতো স্পষ্ট – বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের পারস্পরিক বাকবিতন্ডা সেখানে নিত্যদিনের ঘটনা। প্রায়শই যেটা গালিগালাজের পর্যায়েও পৌঁছায়। ইস্যুগুলো হয়তো ঘন ঘন পাল্টে যায় – কখনো সেটা ক্রিকেট, কখনো বা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ – কখনো আবার তিস্তার জল, পেঁয়াজ কিংবা সীমান্তে বিএসএফের গুলি – কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ক্ষোভের ঢেউ কিন্তু থেমে থাকে না।

এবার বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রতিক ‘ইন্ডিয়া আউট’ নামে ভারত বিরোধী এক ধরনের প্রচারণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইস্টার্ন আইয়ের এক বিশেষ প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয় যে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের পণ্যসহ দেশটিকে ‘বয়কট’ করা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন চলছে। হ্যাশট্যাগের এই প্রচারণাটি ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইন্সটাগ্রামেও এখন শীর্ষে দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ঢাকার অলি-গলিতে এক তরুণ হ্যান্ডমাইক হাতে ভারতের পণ্য বর্জনের প্রচারণা করছেন।

যারা এসব প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ বিরোধী কিংবা সরকার-বিরোধী হিসেবে পরিচিত। আবার অনেকের ধারণা, বাংলাদেশে 'ইন্ডিয়া আউট' প্রচারণার প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক কৌশল করছেন বিএনপি কর্তৃক নিযুক্ত লোকেরা।

এই প্রচারণার ধারণা নেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপের নির্বাচনে ভারত বিরোধী অবস্থান নিয়ে চীনপন্থি নেতা মোহাম্মদ মুইজু মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর। মুইজু ক্ষমতায় বসার পর তিনি প্রথম ইন্ডিয়া আউট প্রচারাভিযান শুরু করেন। এরপরই তিনি ভারতকে তার সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের চাপ দেয়ায় ভারতের সাথে মালদ্বীপের সম্পর্কে ফাটল ধরে।

জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২২৩টি আসনে জয়ী হয়ে চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনার বিজয়কে স্বাগত জানায় নয়াদিল্লী। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা নির্বাচন বয়কট করে। এই নির্বাচনের সুষ্ঠু ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে বিভিন্ন মহলে।

এই নির্বাচনের পরপর দেশ ও দেশের বাইরে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ ‘ইন্ডিয়াআউট’ এই প্রচারণায় তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই যোগ দেন। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব প্রচারণা ভারতেও অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশের এসব প্রচারণার বিরুদ্ধে ভারতের অনেকে ইউটিউবে পাল্টা জবাব দিচ্ছেন।

এই ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্নের উত্থাপন হয়- যদি এই বয়কটের ডাক শুনে ভারত যদি বাংলাদেশকে বয়কট করে তাহলে কি কি হতে পারে? যদি ভারতকে বয়কট করা হয় তবে যেসব সমস্যা হবে সেগুলো কিভাবে পরিপূরণ করবে বাংলাদেশ? চাকরিসূত্রে কিংবা চিকিৎসার জন্যে যেসব বাংলাদেশি কিছুমাস পর পর-ই ভারত গমন করেন, তাঁরা চাইলেও ভারত বয়কট করতে পারবে কি?

বাংলাদেশের মোট সীমান্তের ৫৪৫৬ কিলোমিটার ভারতের সাথে। এর মধ্যে স্থল সীমানা ৪১৫৬ কিলোমিটার এবং সমুদ্র সীমানা ১৩০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বাণিজ্যের বেশিরভাগই ভারতের মাধ্যমে হয়। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হল সড়ক, রেল ও নৌপথ। এই যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলিও ভারতের উপর নির্ভরশীল। গত এক যুগ তা তারও অধিক সময় জুড়ে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল।

ভারত থেকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পণ্য আমদানি হয়। দেশটি থেকে যেসব খাদ্য-পণ্য আমদানি হয় দেশে তার মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, সূর্যমুখী ও সয়াবিন তেলসহ ভোজ্য-তেল, চিনি, মধু, কোমল পানীয়, চিপস, বিস্কুট, চকলেট ও ক্যান্ডি জাতীয় খাবার। চীনের পর ভারত থেকেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে।

ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর, হঠাৎ করে দেশে পেঁয়াজের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশে বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদার ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়, যার ৯৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশার মতে, ঐতিহাসিকভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের পেঁয়াজের গুণগত মান এবং দাম বিবেচনা করলে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক।

বনিক বার্তায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, গত কয়েক দশকে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বড় অগ্রগতি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যদিও প্রতি বছরই দেশে খাদ্যশস্যের আমদানি বাড়ছে। খাদ্যশস্যের মধ্যে এতদিন মূলত চালই আমদানি করা হতো। পণ্যটি প্রধানত ভারত থেকেই আমদানি করা হয় বেশি। এখন গম আমদানিরও সিংহভাগ আসছে ভারত থেকে।

বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ হলো রাষ্ট্রীয় সংস্থার খাদ্যশস্যের সাফল্য এখনো বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারি-বেসরকারি তথ্য বলছে, বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা এখন অনেকটাই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর ভারত থেকে ৩৪১ কোটি টাকার কিছু বেশি মূল্যের চাল আমদানি হয়েছিল দেশে। সেখান থেকে প্রায় ২৪ গুণ বেড়ে গত অর্থবছরে খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৫৪১ কোটি ৭০ লাখ টাকার। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই চাল আমদানিতে রেকর্ড পরিমাণ এলসি খোলার বিষয়টি এরই মধ্যে আলোচনায়ও এসেছে। শুধু চাল নয়, একই চিত্র দেখা যাচ্ছে গমের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ এখন ভারতে উৎপাদিত গমের শীর্ষ গন্তব্য হয়ে উঠেছে। ভারতীয় বাণিজ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের (ভারতে অর্থবছরের হিসাবায়ন হয় এপ্রিল-মার্চ সময়সীমায়) প্রথম নয় মাসে (এপ্রিল-ডিসেম্বর) দেশটি থেকে গম রফতানি হয়েছে ১৪৩ কোটি ২৮ লাখ ডলারের। এর মধ্যে ৮৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের গম এসেছে বাংলাদেশে। সে হিসেবে এ নয় মাসে ভারতের মোট গম রফতানির ৫৮ শতাংশেরও বেশি এসেছে বাংলাদেশে।

কম খরচে চিকিৎসা আর আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রের কারণে বিশ্বে হেলথ ট্যুরিজমে রাজত্ব করছে ভারত। প্রতিবেশী দেশগুলো তো বটেই ইউরোপীয় দেশগুলো থেকেও ভারতে চিকিৎসা নিতে আসে বহু মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ৬৫ থেকে ৯০ শতাংশ কম খরচে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায় বলে মার্কিনিরাও এখানে ভিড় জমায়। দ্য বিজনেস ষ্টান্ডার্ড-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মেডিকেল ট্যুরিস্টদের ৫৪ শতাংশই ছিল বাংলাদেশি। উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশিদের চিকিৎসা সেবার জন্য ভারতের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে খাবার, ভাষা, সাশ্রয়ী চিকিৎসাসেবা এবং সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বলে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে।

‘কি রিজনস ফর মেডিক্যাল ট্রাভেল ফ্রম বাংলাদেশ টু ইন্ডিয়া শীর্ষক এক গবেষণার তথ্যে দেখা গেছে, সাশ্রয়ী ও দক্ষ চিকিৎসা সেবার জন্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, বেসরকারি চাকরিজীবী, ছাত্র-শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা ও শ্রমিকরা বেশি যাচ্ছেন ভারতে। গবেষণায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগই বলেছে, ডাক্তার ও নার্সিংসেবা ভালো পায় বলে তারা সেখানে যায়। ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ৫৫ শতাংশই বাংলাদেশি। গত তিন বছরে মেডিক্যাল ট্যুরিজমে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৮৩ শতাংশ। চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশিরা মূলত ভারতের কলকাতা, নয়াদিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদ ও মুম্বাই শহরে বেশি যাচ্ছে।

ভারতের ব্যুরো অফ ইমিগ্রেশন দপ্তরের হিসেব মতে দেশটিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পর্যটক যায় বাংলাদেশ থেকেই। ২০১৭ সালে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি পর্যটক ভিসায় ভারত ভ্রমণ করেছে যা আগের বছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। আনুমানিক একটি হিসেবে দেখা গেছে গত এক বছরে প্রায় দেড় কোটি মানুষ ভারতের ভিসার জন্য বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রে গিয়েছেন।

বিশ্লেষকদের ধারণা যদিও এই বয়কট ভারতীয় পণ্যের জন্য স্বল্পমেয়াদি ধাক্কা তৈরি করতে পারে, তবে এটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে গবাদিপশুর লাভজনক চোরাচালান বন্ধে কোনো প্রভাব ফেলবে না। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের গুরুত্ব সম্পর্কে এই বয়কট কর্মীদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই ভুল ধারনার মূলে আছে যে, অনেক বাংলাদেশির ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান অংশই হলো শুধু পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও ভারত সম্পর্কে তাদের ধারণা অনেক অস্পষ্ট।

বাংলাদেশে এমন একটি অনুভূতি রয়েছে যে, ভারতীয় শ্রমিকরা ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো জায়গায় স্থানীয়দের কাজ ছিনিয়ে নিচ্ছে। এটি বাস্তবতা নাকি শুধুই অনুমান তা এখনো প্রমাণিত নয়। তবে দুই দেশের মধ্যে অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বিনিময় রয়েছে।

বাংলাদেশে ভারত বয়কটের ডাক দেয়ার পর ভারত যখন এ নিয়ে কোনো সাড়া দেবে না, তখন ক্ষুব্ধ হয়ে এর জবাব দেওয়াটা সঠিক হবে না। এর পরিবর্তে ভারতের উচিত বাংলাদেশের ব্যবসাগুলো যেন ভারতের নিজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে উপকৃত হয় তা নিশ্চিত করা। আর বাংলাদেশে যারা ভারত বয়কটের কথা বলছেন তাদের উচিত বিষয়টি নিয়ে আরও গঠনমুলক চিন্তাভাবনা করা।