জাতীয় পার্টিতে গৃহদাহ | BD Times365 জাতীয় পার্টিতে গৃহদাহ | BdTimes365
logo
আপডেট : ৭ অক্টোবর, ২০২৩ ১৯:৫৬
জাতীয় পার্টিতে গৃহদাহ
কমছে জনপ্রিয়তা
নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় পার্টিতে গৃহদাহ

জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এরশাদ পরিবারে বিভক্তি চরমে। জি এম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে চলছে আধিপত্যের লড়াই। নির্বাচন যখন সন্নিকটে তখন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এমন বিরোধে জাতীয় পার্টির (জাপা) দুর্গ খ্যাত রংপুরের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি স্থানীয় কর্মী-সমর্থকদের উৎকণ্ঠায় ফেলেছে। তারা মনে করেন, দলের বিভক্তি দিনে দিনে জাপাকে দুর্বল করছে, গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করছে। এভাবে চলতে থাকলে দলমত নির্বিশেষে রংপুরে জাপার প্রতি মানুষের যে আস্থা ও ভালোবাসা তা কমে যাবে; মানুষ লাঙল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেবে।

জাতীয় পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রংপুরের জাতীয় পার্টি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। তবে মূল নিয়ন্ত্রণ জি এম কাদের অনুসারীদের হাতে। এ অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা ও সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির। জাপার অপর অংশ দলের কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের অনুসারী। এরা মূলত পরিচালিত হন জাপার সাবেক মহাসচিব ও রংপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গার নেতৃত্বে।
জি এম কাদেরের অনুসারীরা বলছেন, জাপার চেয়ারম্যান ছাড়া দলে বিকল্প কেউ নেই। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবদ্দশায় তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে জি এম কাদেরকে ঠিক করে গেছেন। তা ছাড়া রওশন এরশাদের বয়স ও শারীরিক অবস্থা জাতীয় পার্টিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।

 

জি এম কাদেরের অনুসারীরা মনে করেন, রওশন ও জি এম কাদেরের বিভক্তি অন্তত রংপুরে প্রভাব ফেলবে না। কারণ এরশাদের অবর্তমানে ইতিমধ্যেই নেতাকর্মী ও সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে জি এম কাদের দলের প্রধান নেতা হিসেবে অবস্থান ও সাংগঠনিক পরিচিতি পেয়ে গেছেন।

অন্যদিকে রওশন এরশাদ ও রাঙ্গার অনুসারীদের দাবি, রংপুরের রাজনীতিতে মশিউর রহমান রাঙ্গা একটা ‘ফ্যাক্টর’। তাকে বাদ দিয়ে এখানে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। মোটর শ্রমিকদের ওপর যেমন তার একক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তেমনি জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে তার একটা প্রভাব আছে। অপরদিকে রওশন এরশাদকে সবাই সম্মান করেন, তাকে অভিভাবক মনে করেন। এরশাদ-রওশন দম্পতির ছেলে সাদ এরশাদকে মনোনয়ন দেওয়া না হলে কিংবা রওশনকে অপমান করলে নির্বাচনে তাদের অনুসারীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ জাপাকে বর্জন করবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রওশন ও জি এম কাদেরের মধ্যে লড়াই দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে। যা হুসেইন মোহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকতেও মেটানো যায়নি। এরশাদের মৃত্যুর পর তাদের প্রথম লড়াই শুরু হয় রংপুর-৩ আসনের মনোনয়ন নিয়ে। এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এ আসনটিতে রওশন চেয়েছিলেন ছেলে সাদ এরশাদকে প্রার্থী করতে। কিন্তু জি এম কাদের তা মানতে চাননি। তিনি এই আসনে চেয়েছিলেন জাপার রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসিরকে। এ নিয়ে নানা দেনদরবার শেষে সাদকে প্রার্থী করা হয়।

জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের বাইরেও জাপার একটি অংশ রয়েছে। এই অংশটি ভালোবাসেন প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। এরা মূলত রংপুরের সাধারণ মানুষ। যারা জাপার রাজনীতিতে ততোটা সক্রিয় নন, কিন্তু ভোট দেন লাঙলে। তারা মনে করেন এরশাদ পরিবারের ক্ষমতার বলি জাতীয় পার্টি। এরকম চলতে থাকলে জাপার আবেগ মানুষের মধ্যে কমে যাবে। আলোচনার মাধ্যমে যদি মীমাংসা না হয়, তাহলে সামনের নির্বাচনে আসন হারাতে হবে জাপাকে।

খামার মোড় এলাকায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্কুলশিক্ষক সিরাজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, রংপুরের মানুষ সহজ সরল। যতদিন এরশাদ জীবিত ছিলেন, ততদিন মানুষ দলমত নির্বিশেষে লাঙলে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু সময় পরিবর্তিত হচ্ছে। বিগত উপজেলা নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কাছে জাপার প্রার্থীরা ধরাশায়ী হয়েছেন। একজন এরশাদ সমর্থক হিসেবে চোখের সামনে জাপার জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া মেনে নিতে পারছি না।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ আমাদের ঘরের ছেলে। আমরা চাই এরশাদ পরিবারের মধ্যে যে বিভক্তি তা আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা হোক। জি এম কাদের ও রওশন এরশাদের যে দ্ব›দ্ব তাতে রংপুরে বড় প্রভাব পড়বে না। এখানে জি এম কাদের একক নেতা। তবে আমরা মনে করি নির্বাচনের আগে এ দ্বন্ধের অবসান হবেÑ বলছিলেন রংপুরের তাজহাট এলাকার সিদ্দিকুর রহমান।

তবে তার সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেন নগরীর বাবুপাড়া এলাকার রেজাউল করিম। তিনি বলেন, দেবর-ভাবির এই ঝামেলা নতুন নয়, আগে থেকেই এসব ঝামেলা হয়ে আসছে। এরশাদ মারা যাওয়ার পর থেকে রংপুরে জাতীয় পার্টি দুর্বল হচ্ছে, আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হচ্ছে। জাপা থেকে গত সিটি নির্বাচনে মেয়র জিতলেও কাউন্সিলররা কিন্তু অনেকেই পরাজিত হন। তা ছাড়া বর্তমানে রংপুরের ৬টি আসনের মধ্যে মাত্র দুইজন এমপি জাপার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রংপুর জাপার একাধিক নেতা জানান, আগামী নির্বাচনে রংপুর-৩ আসন থেকে প্রার্থী হতে চান জি এম কাদের। কেননা এ আসন থেকে সবসময় এরশাদ নির্বাচন করেছেন। এরশাদের বাড়ির আসন হওয়ায় এখানকার সাধারণ ভোটাররাও লাঙলে ভোট দেন। ফলে তুলনামূলকভাবে সহজে জেতা যাবে।

অন্যদিকে জাপার রাজনীতিতে এ আসনে নির্বাচন করা গৌরবের। জি এম কাদের মূলত এ আসনে নির্বাচন করে দলের চালিকাশক্তি নিজের হাতে নিতে চান। তাছাড়া আসনটি সিটি করপোরেশন এলাকায় হওয়ার কারণে জাপা থেকে নির্বাচিত বর্তমান মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফার বড় প্রভাব ও প্রশাসনিক সুবিধা নেওয়া যাবে। সুতরাং এখানে প্রার্থী হতে পারলে জয় অনেকটাই নিশ্চিত।


বিষয়টি আগে থেকেই অনুমান করতে পারছিলেন রওশন এরশাদ। তিনি যেকোনো মূল্যে আগামী নির্বাচনে আবারও ছেলেকে প্রার্থী করতে চান। কেনোনা সাদ এরশাদের পক্ষে অন্য কোন আসন থেকে নির্বাচন করে জয় লাভ করা সম্ভব নয়। এদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে কোনো আসন ছেড়ে দিতে চান না তারা। এরশাদের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঘোষণা করেও পরবর্তীতে এরশাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এবার আসনটি দখলে নিতে আগামী নির্বাচনে মরিয়া আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে জাতীয় পার্টিতে রয়েছে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে টানাপোড়েন।

তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করেন দলের মতভেদ দূর না হলে আগামী নির্বাচনে আসন হারিয়ে মূল্য চুকাতে হবে জাপাকে।

এক সময়ের দুর্ঘ হিসেবে পরিচিত রংপুর বিভাগের আট জেলার ৩৩টি সংসদীয় আসনের মধ্যে মাত্র সাতটিতে সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির। অন্যদিকে ৫৩৫টি ইউনিয়ন পরিষদের সর্বশেষ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভরাডুবি হয়েছিল। এর মধ্যে ২১৩ জন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১৩ জনই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। এ সময় দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচন থেকে দূরে থাকলেও স্বতন্ত্র হিসেবে ৭৫টিতে জিতেছিলেন বিএনপির প্রার্থীরা। এমনকি জামায়াত ও ৫৬টি ইউনিয়নে জয়লাভ করে। পক্ষান্তরে মাত্র ৩৬টিতে জিতেছে জাতীয় পার্টি। এ ছাড়া দুটিতে জাসদ, একটিতে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং ৩৯টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেন।

সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। কিন্তু কাউন্সিলরদের ৪৪টি পদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৩ জন, জাতীয় পার্টির ৯ জন জয়লাভ করেন। এ ছাড়া রংপুরের আটটি উপজেলার মধ্যে মাত্র একটিতে জাতীয় পার্টি সমর্থিত চেয়ারম্যান রয়েছেন। বাকি সাত উপজেলায় দলের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করতে পারেননি।

ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে রংপুর বিভাগের ৩৩ আসনের মধ্যে জাপা ১৭টি, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২১টি, ২০০১ সালের নির্বাাচনে ২১টি থেকে কমে ১৪টি আসন পায় জাতীয় পার্টি।

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে চার দলীয় ঐক্যজোটের বিপরীতে আওয়ামী লীগ-জাপার সমন্বয়ে গঠিত হয় মহাজোট। এরপরও নবম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন কমে পায় ১৩টি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করে। সে সময় তারা মাত্র ৭টি আসন পায়। একইভাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তারা মাত্র ৭টি আসন পেয়েছিল।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুরের সভাপতি অধ্যাপক ফখরুল আনাম বেঞ্জু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির প্রতি রংপুরের মানুষ হতাশ। রওশন-জিএম কাদের-রাঙ্গা তাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তা এখানে জাতীয় পার্টিকে আরও দুর্বল করছে।’ তিনি মনে করেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করার পর থেকে রংপুর বিভাগে জাতীয় পার্টির আসন কমেছে। জোট করতে গিয়ে দলটি নিজের ক্ষতি করেছে। যতই বলুক রংপুর তাদের দুর্গ, বাস্তবতা হচ্ছে জাতীয় পার্টির এ দুর্গের পতন অনেক আগেই হয়েছে।

মশিউর রহমান রাঙ্গার অনুসারী রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সহসভাপতি ও মোটর মালিক সমিতির নেতা আবদুল মান্নান মনে করেন, জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের দ্বন্দ্ব নির্বাচনের আগেই দূর হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘এরশাদ পরিবারে যে বিভেদ চলছে, তা রংপুরের তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর একটা প্রভাব ফেলছে। এ বিভেদ কেউই ভালোভাবে নিচ্ছে না।’

দলটির রংপুর মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির বলেন, ‘রংপুরে জিএম কাদের ছাড়া কোনো নেতা নেই। তাকে কেন্দ্র করে রংপুর জাতীয় পার্টি অত্যন্ত শক্তিশালী।’ তিনি দাবি করেন, ‘বিগত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের পরাজিত করেছেন। রংপুরে এখনো আমরা এককভাবে শক্তিশালী ও জনপ্রিয়।’