আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ১২:৩৭

মুম্বাইয়ের শহরতলির নর্দমায় চিত্রশিল্পীর অর্ধনগ্ন লাশ

জয়ন্ত সাহা
মুম্বাইয়ের শহরতলির নর্দমায় চিত্রশিল্পীর অর্ধনগ্ন লাশ
ফাইল ছবি

আরুষি তলোয়ার, অভিনেত্রী জিয়া খান বা লায়লা খান এবং অতি সম্প্রতি শিনা বরা— রহ্যসময় মৃত্যুকাণ্ডে হাই প্রোফাইল মামলাগুলোর সুরাহা হতে না হতেই আরও এক শিল্পীর রহস্যজনক মৃত্যুর খবরে চঞ্চল হয়ে উঠেছে মুম্বাই। 

ভারতের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, শনিবার সন্ধ্যায় মুম্বাই শহরতলির কান্দিভলি এলাকায় নর্দমাতে পাওয়া গিয়েছে খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী হেমা উপাধ্যায় (৪৩) এবং তার আইনজীবী হরিশ ভামভানির (৬৫) অর্ধনগ্ন লাশ। 

মুম্বাই পুলিশ জানিয়েছে, দুটি লাশই মিলেছে হাত-পা বাধা অবস্থায়। বড় প্লাস্টিকে মুড়ে তার পর সেগুলো কার্ডবোর্ডের বাক্সে পুরে কেউ ফেলে রেখে গিয়েছিল নর্দমার পাশে।

সন্ধ্যায় দেহগুলি যখন উদ্ধার হয়, তার আশপাশে শনাক্তকরণের মতো কিছুই ছিল না। মোবাইল, মানিব্যাগ বা গয়নাগাঁটি কিছুই মেলেনি দেহের সঙ্গে। তাই পুলিশের দেহ শনাক্ত করতে রোববার সকাল হয়ে যায়।

পুলিশ সূত্রে খবর, হাত-পা বাধা অবস্থায় প্রায় অর্ধনগ্ন দেহ দুটি প্যাকেটে মুড়ে সেলাই করে দিয়ে ভরা হয়েছিল বাক্সে। দুজনেই মুখই ছিল বাধা। 

দেহ দুটি দেখে পুলিশের মনে হয়েছে, সেভাবে পচন ধরেনি। তারা অনুমান করছে মাত্র দুদিন আগে হয়তো খুন করা হয়েছিল হেমা ও হরিশকে।

কে বা কারা ওই বাক্সে ভরে দেহ দু’টি ওভাবে ফেলে রেখে গিয়েছিল, তা নিয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, তাদের গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। শরীরের বাইরে আর কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

এর আগে গত শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার পর থেকে হেমা-হরিশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ।

অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আপাতত খুনের মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। দেহ দুটি পাঠানো হয়েছে ময়না-তদন্তে।

মুম্বাই পুলিশের অপরাধ দমন শাখা এই ঘটনার তদন্ত করছে। এখনও কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। হেমা এবং হরিশের পরিচিত লোকজনকে আপাতত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি সূত্র দাবি করছে, হেমার সাবেক স্বামী চিন্তন উপাধ্যায় এবং তার পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

মুম্বাই পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বিক্রম দেশপাণ্ডে বলেছেন, “এখনও পর্যন্ত ঘটনাক্রম দেখে এটা খুন বলেই মনে হচ্ছে। তবে কী ভাবে খুন, ময়না-তদন্তের পরে কিছুটা বোঝা যাবে।”

শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার পরে হেমা-হরিশের টেলি-কথোপকথন ছাড়া আর কোনও রেকর্ড নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ।

হেমা জন্মসূত্রে বদোদরার বাসিন্দা। বদোদরার এম এস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিল্পকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন হেমা।

১৯৯৮ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন শিল্পী চিন্তন উপাধ্যায়কে। ২০১০ সালে বিচ্ছেদের মামলা করেন দুজনে। বিবাহ বিচ্ছেদের পর চিন্তন মুম্বাই ছেড়ে দিল্লি চলে যান।

চিন্তন-হেমার দাম্পত্যজীবন খুব যে মধুর ছিল না জানা গেল ২০১৩ সালে।

তার অভিযোগ ছিল, মুম্বাইয়ে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঘরের দেয়ালে অশালীন ছবি এঁকেছিলেন চিন্তন। বিবাহবিচ্ছেদ ও হেনস্থার অভিযোগের মামলা— দুটোতেই হেমার আইনজীবী ছিলেন হরিশ।

তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, সম্পত্তি নিয়ে গোলমালের জেরে স্বামীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন হেমা; চলছিল বিচ্ছেদের মামলাও। আদালতে এই সব মামলাতেই হেমার হয়ে সওয়াল করছিলেন আইনজীবী হরিশ ভামভানি।

স্বাভাবিকভাবে পুলিশের প্রাথমিক সন্দেহ এখন চিন্তনের দিকেই। তিনি এখন দিল্লিতে থাকেন। রেববারই তাকে মুম্বাই ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ।

পুলিশ সূত্র বলছে, গত শুক্রবার গভীর রাতেও জুহুর বাড়িতে না ফেরায় হেমার পরিচারক হেমন্ত মণ্ডল মালকিনকে বেশ কয়েকবার ফোন করেন, কিন্তু সাড়া মেলেনি। তার পর রাত একটা নাগাদ সান্তা ক্রুজ থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন তিনি। হেমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এমনকি চিন্তনকেও হেমার নিখোঁজ হওয়ার খবর দেন।

হেমন্তের দাবি, সে দিন বাড়ি থেকে সকাল-সকাল বেরিয়ে হেমা সোজা চলে যান আন্ধেরির বীর দেশাই রোডের কাছে নিজের স্টুডিও ‘লক্ষ্মী ইন্ডাস্ট্রিজে’। তারপর সেদিন সন্ধাবেলা মালকিনের গলা ফোনে শেষ বার শুনেছিলেন হেমন্ত।

হেমার সেই স্টুডিওর সিসিটিভি ফুটেজ এসেছে পুলিশের হাতে। যাতে দেখা যাচ্ছে, শুক্রবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ একটি হন্ডা সিটি গাড়িতে হেমা তার আইনজীবী হরিশের সঙ্গে স্টুডিও চত্বর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। সেই গাড়িটির তার পর থেকে খোঁজ নেই বলে পুলিশের দাবি।

শুক্রবার বাড়ি না ফেরায় মাতুঙ্গা থানায় শনিবার দুপুরে অভিযোগ জানিয়েছিলেন হরিশ ভামভানির পরিবারও।

পুলিশ বলছে, শুক্রবার সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ মাতুঙ্গায় কিঙ্গ সার্কেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান হরিশ। বলে যান, আন্ধেরিতে এক মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। তারপর আর ফেরেননি বলে দাবি পরিবারের।

এই ঘটনায় পুলিশের প্রাথমিক সন্দেহ যেমন চিন্তনের দিকে, হেমার বন্ধুরাও কিছুটা তেমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন।

কেউ অবশ্য এটা বলছেন না, যে চিন্তন খুন করতে পারেন। তবে হেমার পাশে চিন্তন ‘একেবারেই অন্য ধরনের মানুষ’ বলে মনে করছেন তারা।

বদোদরার এমএস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা বিভাগের দুই ছাত্রছাত্রী হেমা-চিন্তনকে সেই সময় থেকেই চিনতেন বৈভব বিশাল নামে তাঁদের এক বন্ধু। বৈভব বলছেন, ‘‘মৃদুভাষী, সদাহাস্যময় হেমাকে সকলেই পছন্দ করত। তার শিল্পকর্মও প্রশংসা কুড়িয়েছিল।”

কিন্তু হেমার সঙ্গে চিন্তনের প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়ায় অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। কারণ চিন্তন একেবারেই বিপরীত প্রকৃতির বলে মনে করতেন সবাই। শেষমেশ তাদের বিয়ে হয় বলে জানাচ্ছেন বন্ধুরা।

শিল্পী হিসেবে হেমার পৃথক সত্তা তৈরি হওয়ার পরে স্বামী হিসেবে চিন্তন নিরাপত্তহীনতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন মনে করছেন দুজনের বন্ধুরা। ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্কটের জেরে থেমে যায়নি হেমার শিল্পী-সত্তা, দাবি পরিচিতদের।

হেমার এগিয়ে যাওয়াই কি মানতে পারেননি চিন্তন? তবে সেই তিক্ততার ফলে হেমার এই পরিণতি হবে, ভাবেননি কেউই।

কে বা কারা শেষ করে দিল সম্ভাবনাময় এই শিল্পীর জীবন? এখন এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে তার স্বজন ও বন্ধুদের মনে।

সূত্র: এনডিটিভি, হিন্দুস্থান টাইমস, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

 

বিডিটাইমস৩৬৫ডটকম/জেএস/একে

উপরে