মাইশার শেষ চিঠি পৌঁছায়নি গন্তব্যে | BD Times365 মাইশার শেষ চিঠি পৌঁছায়নি গন্তব্যে | BdTimes365
logo
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০২:৫২
আবার ফিরে এলো আগুন সন্ত্রাস। পুড়ছে গাড়ি মরছে মানুষ
মাইশার শেষ চিঠি পৌঁছায়নি গন্তব্যে
সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন

মাইশার শেষ চিঠি পৌঁছায়নি গন্তব্যে

যশোরে মাইশা ও তার বাবার জানাজা

৩ ফেব্রুয়রি ২০১৫ ।
ক্ষমতায় যেতে উত্তাল বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলগুলো।  বিরোধী শিবির কোনভাবেই পেরে উঠছে না তৎকালিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে। উত্তাল সে সময়ে প্রতিদিনই রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল। সবই রাজনৈতিক সহিংসতা। শিকার অফিস ফেরত সাধারণ মানুষ । নিরীহ বাসের যাত্রী। গার্মেন্টস কর্মি। দিনমজুর। কত বিভৎস কত ভয়ঙ্কর অথবা কত মর্মান্তিক উপায়ে মানুষের মৃত্যু হতে পারে সে সময়ে জাতি তা দেখেছে। ভোররাতে ট্রাক চালক বাবার সামনে বাবার চালিত ট্রাকে ঘুমিয়ে থাকা ১৩ বছরের ছেলেকে জাতি দেখেছে ঝলসে  যেতে কাবাবের মত। বাবা শুধু পানি ছিটিয়ে যাচ্ছে। আর তার ১৩ বছরের ছেলে পাথরের মত নিশ্চুপ হয়ে যন্ত্রণার মৃত্যু উপভোগ করছে। উত্তাল সে দিনগুলিতে  ২ ফেব্রুয়ারী  কক্সবাজারে ছুটি কাটিয়ে বাবা নুরুজ্জামান পভলু ও মা মাফরুহা বেগমের সঙ্গে কক্সবাজার থেকে যশোর ফিরছিলেন মাইশা নাইমা তাসনিন নামে এক কিশোরী। ভোররাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে তাদের বাসটিতে পেট্রল বোমা ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দেয় অবরোধকারীরা। যশোর শহরের সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা জাসদ নেতা নুরুজ্জামান পভলু (৪৮) প্রথমে জানালা দিয়ে  স্ত্রী মাফরুহা বেগমকে ছুঁড়ে ফেলতে পারলেও মেয়ে মাইশা (১৫) এবং নিজে  (৪৮) জীবন্ত পুড়ে মৃত্যুবরণ করেন।  আইকন পরিবহনের সেই বাসে আরও যারা শতভাগ পুড়ে মারা যান কক্সবাজারের চকরিয়ার ইউসুফ (৫৫) ও তাহের (৩৮), নরসিংদীর আসমা বেগম (৩৮) ও তার ৫ বছরের মেয়ে শান্ত। আবারও ফিরে এলো আগুন সন্ত্রাস। গত ১৮ ডিসেম্বর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয় দূবৃত্তরা। আগুনে পুড়ে নিহত হন নাদিরা আক্তার পপি ও তার শিশু সন্তান ইয়াসিন রহমান পিয়াস। প্রতিবার ভোটের সময় এলে অবধারিত কিছু মৃত্যু। যার দায়ভার নেয় না রাষ্ট্র। সমাজ। দেশ।  

নিচের উপখ্যানটি মাইশা নাইমা তাসনিন নামে এক কিশোরীর মর্মন্তদ মৃত্যুর কাহিনী। এটি বাংলাদেশে পশ্চাদপদ  ও ক্রমশ: নিম্নগামী রাজনীতিধারার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণও বটে। মাত্র ৩০ মিনিটে অপার্থিব যন্ত্রণায় মাইশার মৃত্যুযাত্রার বিশদ বিবারণ পড়ে হয়ত শিউরে উঠবে কেউ কেউ। কিন্তু মাইশা নারকীয় যন্ত্রণা পেয়েছে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশী ।
আজ মাইশা বেঁচে থাকলে বিজয়ের তেপ্পান্ন বছরে আজ তার বয়স হত তেইশ।


‘আমার এই পা দুটিতে যখন পেট্রোলে ছোড়া আগুন লাগে তার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম ভাঙলো আগুনের ছ্যাঁকায়। তড়িৎ পায়ের মোজা খুলতে খুলতেই আমার সাড়া শরীরে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন।

কী অপার্থিব কষ্ট ও যন্ত্রণা তখন আমার সারা শরীর জুড়ে? আমার শরীরের পোড়া গন্ধ তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অদূরেই দেখি বাবা সারা শরীরে আগুন নিয়ে ছুটে আসছেন আমার দিকে; সন্তানের গায়ের আগুন নেভাতে। কিন্তু সর্বনাশা আগুন তারও সর্বস্ব গ্রাস করে নিয়েছে। আমি চিৎকার করছি ‘বাবা বাঁচাও, বাবা বাঁচাও’।

বাবা জ্বলতে জ্বলতে দাঁড়ানো থেকে ধপ করে পড়ে গেলেন। বাসের মাঝখানে হাটার জায়গাটি অপ্রশস্ত। এই পথ ধরেই তিনি হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকলেন। সন্তানকে রক্ষা করতে সারা শরীরে আগুন নিয়ে এক বাবা ঘোস্ট রাইডারের মতো আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আপনারা কি খখনও দেখেছেন? জীবিত একজন মানুষ জ্বলছে?  আর তার সারা শরীর থেকে মাংস খসে পড়ছে? দেখেছেন কখনও?


বাবা আমার দিকে আসছেন ক্ষীণ গলায় আমাকে কী যেন বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আগুন বাবার মুখের সে কথাগুলো কেড়ে নিচ্ছে। আমি চিৎকার করছি।
এবার আগুন আমার পা থেকে উপরের দিকে উঠে আসছে। আমার চোখের সামনে বাবা পুড়ছেন। আমি পুড়ছি। অদূরে চেয়ে দেখি আমার মা বাসের বাইরে চিৎকার করছেন আর তাকে ধরে রেখেছে কয়েকজন। সবাই যেন আমাদের পুড়ে যাওয়াটা আতঙ্কের চোখ নিয়ে উপভোগ করছে। কয়েকজনকে দেখছি মোবাইলে ভিডিও করছে। এর মধ্যে কয়েকজন সাংবাদিক লাইভ নিউজ শুরু করে দিয়েছে। ফায়ার ব্রিগেডের দুটো গাড়ি দেখলাম পানি কোথায় পাওয়া যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করছে। সবাই একরকম মেনেই নিয়েছে আমার করুণ নিয়তি। বাাঁচাতে আসছে না কেউ । 

চোখের সামনেই বাবার মাথা আগুনে গ্রাস করে নিল। মুখ পুড়ে মাংস গলে গলে খসে পড়তে লাগলো বাসের মেঝেতে। চেয়ে দেখছি বাবার খুলি পুড়ছে। চোখ পুড়ছে। চোখগুলো থেকে কেমন যেনো আঁঠালো কালো কালো রস গড়িয়ে পড়ছে। মাথার খুলিটা যেনো কয়লার আগুনে লাল হয়ে যাওয়া লোহার পিণ্ড। বাবার হাত থেকে সব মাংস পুড়ে খসে পরলো। এখন শুধুই কংকাল। এটাকেও রেহাই দিলো না আগুন। এবার হাড়গোড় ও জ্বলছে বাবার।
 

বাবা আর পারলেন না। আমার পায়ের কাছে এসে আছড়ে তিনি তার মানবীয় সব রূপ হারিয়ে একটি কাঁদার দলার মতো আমার পায়ের কাছে ছোট একটি পিণ্ডকায় বলের মতো আছড়ে পড়লেন।
ম্যাডাম,

প্রিয় ক্ষমতালোভী মানুষগুলো
আপনারা  কি জানেন?  মানুষকে পোড়ালে ছোট হয়ে যায়? হাত পা মাথা এক জায়গায় হয়ে যায়। এটা আমার এই ছোট্ট জীবনে এক নিদারুণ নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা। বাসের বাইরে মা তখনও দিশেহারা হয়ে বুক চাপড়াচ্ছেন। আগুনের লেলিহান শিখা আর কালো ধোঁয়ার মাঝেও আমিও চিৎকার করে মাকে ডাকছি ‘মা আমাকে বাঁচাও।’ মা ছুটে আসতে চাইলেও তাকে ধরে রাখছে কয়েকজন।

এবার আগুন আমার বুক পর্যন্ত উঠে এসেছে। এতক্ষণ আমি বাবার সাহায্যের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু এখন বাবা একটা পোড়া মাংসের দলা। মাঝখানে উঁকি-ঝুকি মারছে কিছু পুড়ে যাওয়া হাড়গোড়। আমার এত সুন্দর বাবা আজ এক কুৎসিত জড় থকথকে আঁঠালো পোড়া মাংস পিণ্ড।
জ্বলছে আমার সারা শরীর।

পুড়তে পুড়তে এখন আমার শরীরে আর কোন যন্ত্রণা নেই। ভাবছি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বাবার স্বপ্নের কথাগুলো। বলছিলেন ‘মা এটা হচ্ছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা এর সদ্বব্যবহার করতে পারিনি। শুধু রাজনীতির হানাহানি আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে বারবার। সাগর পাড়ে বসে আমি শপথ নিয়েছিলাম আমিও রাজনীতি করবো। এই দেশ বদলাতে হলে সবার আগে রাজনীতির ত্রুটিকে বদলাতে হবে।
আগুন আমার মাথা পর্যন্ত উঠে এসেছে। জ্বলছে দাউ দাউ করে। আমার পোড়া চামড়া খসে পড়ছে, কোথাও কোথাও মাংসপিণ্ডও। এগুলো নিয়ে আর ভাববার সময় নেই। মনে পড়ছে বাবার কত স্বপ্ন ছিলো আমাকে নিয়ে। সেগুলো সব আমাকে পূরণ করতে হবে।
হাতের আঙ্গুলগুলো জ্বলতে জ্বলতেই খসে পড়ে গেলো পায়ের কাছে। পা মানে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া একটি কাঠ কয়লার খণ্ড। প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে, নিজের মাংস পোড়া গন্ধ নিজেই সহ্য করতে পারছি না। চোখে রাজ্যের ঘুমে জড়িয়ে আসছে। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। মায়ের চিৎকারে আমার তন্দ্রা ছুটে গেলো।

মা.....আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার বায়নাতেই তোমরা আমাকে কক্সবাজার দেখাতে নিয়ে এসেছিলে..... আমি আর কোনোদিন কক্সবাজার দেখতে চাইবো না।
মা চিৎকার করছেন- কেউ কি আছো আমার মেয়েটাকে বাঁচাও.....


বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। কান্নাও এলো, কিন্তু সর্বনাশা আগুন সেই জলটুকুও শুষে নিলো।এবার আমার মাথার মগজ পুড়ছে। গলে বেরিয়ে আসছে চোখ মুখ ও নাকের কোটর দিয়ে। আমার কেমন যেন লাগছে। মনে হয় হাওয়ায় ভাসছি। কেমন যেনো অন্যরকম লাগছে চারপাশ । কোন যন্ত্রণা নেই আর। নিস্তব্দ চারিধার। নীজেকে কেমন যেন হাওয়াই বেলুনের মতো লাগছে নীজের শরীরটাকে। আমি আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছি......

এটাকেই মৃত্যু বলে তা হলে। আমি যেন অনন্তকাল ধরে মৃত্যুর পথে হেটে যাচ্ছি।


বিদায় আমার জন্মভূমি। ভালো থাকুক বাংলাদেশ।

ইতি
মাইশা নাইমা তাসনিন
২০০১-২০১৫