বেলুচিস্তানে নিরব গণহত্যা! শেষ হবে কবে? | BD Times365 বেলুচিস্তানে নিরব গণহত্যা! শেষ হবে কবে? | BdTimes365
logo
আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ ২২:১৯
বেলুচিস্তানে নিরব গণহত্যা! শেষ হবে কবে?
সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন

বেলুচিস্তানে নিরব গণহত্যা! শেষ হবে কবে?

২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। বেলুচিস্তানের দেরা বুগতি জেলার গৈন্ধরি গ্রামে তখন সূর্য উঠেছে মাত্র। এরই মধ্যে আকাশ কাঁপিয়ে ধেয়ে এলো ১০টি পাকিস্তানি বেল এইচ হেলিকপ্টার। মুহূর্তেই আকাশ থেকে গুলি ও বোমা ছুড়তে শুরু করল কপ্টারগুলো। পাশাপাশি স্থল সেনারাও ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর। নির্বিচারে চলল ঘণ্টা তিনেকের গণহত্যা। গ্রামের প্রতিটি ঘরেই দেওয়া হলো আগুন। মানুষ নিধনের মহোৎসবে বৃদ্ধ-যুব-শিশু কেউই বাদ পড়ল না। মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া হলো পাকিস্তানি সেনা ছাউনিতে। ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা চার দিনের ওই সেনা অভিযানে নিহত হলো ৩৪ জন গ্রামবাসী আর নিখোঁজ পঞ্চাশের অধিক মানুষ। তাদের মধ্যে শাম্মি বুগতি নামে এক নারীর ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ সেনা অভিযানের ৩০ দিন পর ২২ অক্টোবর হেলিকপ্টার থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। ওই অভিযানে তার স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিহত হয়েছিল। আর তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। গৈন্ধরিতে শাম্মির মৃতদেহ কবর দেওয়ারও মানুষ ছিল না দুই দিন। পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সম্পদশালী বড় প্রদেশটিতে প্রতিদিনই ঘটে যাওয়া মানবিক বিপর্যয়ের একটি ঘটনার বর্ণনা আমাকে বলছিলেন বেলুচ মানবাধিকার সংস্থার (বিএইচআরও) সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আব্বাস বেলুচ। ছয় বছর আগে তিনিও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে জার্মানিতে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন।

আব্বাসের বয়সী তরুণ প্রজন্মের বেলুচরাই এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। কারণ অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত বেলুচ নবপ্রজন্ম ৮০ বছর ধরে চলমান বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। স্বাধিকারের আন্দোলনকে বর্তমানে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের আন্দোলনে পরিণত করেছে এই তরুণ প্রজন্মই। এ ছাড়া বেলুচিস্তানের মুক্তিসংগ্রামে শামিল হয়েছে কমপক্ষে ১২ টি রাজনৈতিক দল। বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ), বেলুচ রিপাবলিকান আর্মি (বিআরএ), বেলুচ লিবারেশন ফ্রন্ট, ইউনাইটেড বেলুচ আর্মি (ইউবিএ), লস্কর-ই-বেলুচিস্তান (এল-ই-বি), বেলুচিস্তান লিবারেশন ইউনাইটেড ফ্রন্ট অন্যতম।

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে পুরুষরা গুমের শিকার হয়ে আসছেন সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। নিখোঁজ স্বজনদের ফিরে পেতে প্রতি বছর বেলুচ নারীরা পায়ে হেটে কোয়েটা থেকে ইসলামাবাদে আসে। যাত্রাপথে নানা প্রতিকুলতা পাকিস্তানী পুলিশ ও সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তারা ইসলামাবাদে এলেও কার্যত বিফল মনে ফিরে যেতে হয়ে তাদের। কারণ দেশটির সরকার ও ক্ষমতাসীনরা বেলুচদের অধিকার নিয়ে সব সময়ই উদাসিন থেকেছে।

গত ৬ ডিসেম্বর বেলুচ নারীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া লং মার্চ রাজধানী ইসলামাবাদে পৌঁছলে পুলিশ তা ছত্রভঙ্গ করতে জল কামান এবং টিয়ার গ্যাস ছুড়েছে। বিক্ষোভে নেতৃত্বে দেওয়া মাহরাং বালোচসহ অন্তত ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বেলুচিস্তানের পুরুষরা গুম এবং বিনা-বিচারে হত্যার শিকার হওয়ার অভিযোগ ওঠার পর থেকে এর বিরুদ্ধে কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেশজুড়ে পদযাত্রা করে আসছে বিক্ষোভকারীরা। অতিসম্প্রতি এক বেলুচ পুরুষের মৃত্যুর পর বিক্ষোভ আরও জোরদার হয়েছে। নিহত ব্যক্তির স্বজনদের অভিযোগ, পুলিশ কাস্টডিতে থাকার সময় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানের জিও নিউজ জানায়, বেলুচ নারীদের নেতৃত্বে লং মার্চ শুরু হয়েছিল গত ৬ ডিসেম্বরে। বুধবারে নারীরা লং মার্চ নিয়ে রাজধানী ইসলামাবাদে পৌঁছায়। স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্ট হওয়া ভিডিওতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে বিক্ষোভকারীদের বেঁধে পুলিশের গাড়িতে তুলতে দেখা গেছে পুলিশ কর্মকর্তাদেরকে। এ সময় অনেকেই চিৎকার করছিল এবং কাঁদছিল। আবার অনেককে আহত অবস্থায় মাটিতে বসে থাকতে দেখা গেছে।

টেলিফোনে আব্বাস বলেন, কার্যত বেলুচিস্তানে গৃহযুদ্ধ নয়; নিরবে গণহত্যা চলছে। আমাদের এখানে ১৯৪৮ সাল থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রতিদিনই নিরীহ বেলুচদের হত্যা করে আসছে। ২০০৩ থেকে গাওদর গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরপরই সেনাবাহিনী হামলা ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ‘কসাই’-খ্যাত টিক্কা খানও একসময় বেলুচিস্তানে নিরীহ মানুষদের হত্যাযজ্ঞে নিয়োজিত ছিলেন। বেলুচিস্তানে তার ওই কুখ্যাতির কারণেই তাকে ১৯৭১ সালে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল বলে জানান তিনি। গণহত্যার পুরস্কারও পেয়েছিলেন টিক্কা খান। ১৯৮৮ সালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির হয়ে পাঞ্জাবের গভর্নরও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। আব্বাস জানান, ১৯৭১ সালে বেলুচিস্তানের মুক্তিকামী মানুষ বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন। তারাও সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দিয়েছিল।

‘পৃথিবীর কোনও সংবাদমাধ্যমকেই বেলুচিস্তানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না’ উল্লেখ করে আব্বাস বলেন, এ কারণে এই ব্যাপক গণহত্যার খবর বাইরের বিশ্বে যায় না। যেটুকু যায় তাও আবার ঘটনা ঘটে যাওয়ার অনেক দিন পর। এ কারণে এসব সংবাদ বিশ্ব মিডিয়ায় তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। বেলুচিস্তানের গণহত্যাকে ‘সিসটেমেটিক জেনোসাইড’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আয়তনের দিক দিয়ে বেলুচিস্তান পাকিস্তানের প্রায় ৪৬ শতাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত হলেও এখানে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে আটটি। এর মধ্যে মাত্র একটি মধ্যম মানের, অন্যগুলো নামমাত্র। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বেলুচ ভাষার পরিবর্তে শেখানো হয় উর্দু। পাকিস্তানের মোট উৎপাদনের ৪৫ শতাংশ গ্যাস বেলুচিস্তান থেকে উত্তোলন করা হলেও তা পাইপলাইনে চলে যায় পাঞ্জাব প্রদেশে। এখানকার মানুষ গ্যাস পায় না। বেশির ভাগ পরিবারে রান্নাবান্না হয় কাঠখড় পুড়িয়ে।

এখানকার সোনা, তামা, মার্বেল পাথরসহ মূল্যবান সব প্রাকৃতিক সম্পদের পুরোটাই ভোগ করে পাঞ্জাব জনঅধ্যুষিত কেন্দ্রীয় সরকার, তারাই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করছেন। তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করতে বেলুচদের মধ্যে মাদক বিক্রি ও সেবন- এ দুটো সুকৌশলে ঢুকিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)। এতে দিন দিন অধগতিতে যাচ্ছে বেলুচিস্তানের যুবসমাজ। সরকারি চাকরির উঁচু পর্যায়ের জায়গাগুলোতে যোগ্যতা থাকলেও জায়গা পাচ্ছে না বেলুচরা।

বেলুচ জাতীয়তাবাদী নেতা ও বেলুচ রিপাবলিকান পার্টির (বিআরপি) প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব বারহুমদাগ বুগতি সম্প্রতি জেনেভায় ক্লাব সুইচ ডি লা প্রেসে (জেনেভা প্রেস ক্লাব) এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রতিদিনই বেলুচিস্তানের কোনও না কোনও জায়গায় সেনা অভিযান চলছে। তারা নিরীহ মানুষকে মারছে, নয়তো তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, গত ১৬ বছরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে এক লাখ ৪০ হাজার নিরীহ বেলুচ নিহত হয়েছে। আর গুম হয়েছে ২৩ হাজারের বেশি ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী। রেহাই পাচ্ছে না নারীরাও। আগামী প্রজন্মের বৃদ্ধি রোধ করার জন্য নারী ও শিশুদেরও হত্যা করা হচ্ছে। বেলুচ নারীদের ওপর চালানো হচ্ছে পাশবিক নির্যাতন। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানি সেনারা এখন ‘ধরো, হত্যা করো আর গুম করো’- এই নীতিতে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিনই এ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় গণকবরের সন্ধান মিলছে। আর তাতে পাওয়া যাচ্ছে ‘নিখোঁজ’ বেলুচদের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। তিনি ওই সংবাদ সম্মেলনে বেলুচিস্তানের মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র বিশ্ব মিডিয়ার কাছে তুলে ধরার আহ্বান জানান। নওয়াব নিজেও একজন ভুক্তভোগী। ২০০৬ সালে তার দাদা সরদার আকবর বুগতিকে একটি গুহার মধ্যে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। সে সময় তার বয়স ছিল ৮০ বছর। এ ছাড়া ২০১২ সালে করাচিতে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয় তার আপন বড় বোন ও তার ১২ বছরের মেয়েকে। আইএসআইয়ের এজেন্টরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল বলে বিআরপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলেও এর কোনও বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। তার মতো হাজার হাজার মুক্তিকামী বেলুচ রয়েছে যাদের প্রত্যেকের পরিবারের কেউ না কেউ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে খুন বা গুম হয়েছে।

গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর বিবিসি উর্দু বিভাগ থেকে প্রচারিত এক সংবাদে জানা যায়, বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা, কালাত, খুজদার, মাকারানসহ বিভিন্ন এলাকায় গত ছয় বছরে বেশ কটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং সেগুলোতে এক হাজার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া গেছে। নিহতদের স্বজনরা বিবিসিকে জানিয়েছে, এদের সবাই সেনাবাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিল। তাদেরই একজন কোয়েটার উপকণ্ঠের সারইয়াবের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ জলিল রেকি। ২০০৯ সালে তাঁকে নিজ বাসস্থান থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায় আইএসআইয়ের লোকরা। এর দুই বছর পর তার ছিন্নভিন্ন গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায় ইরান সীমান্তের কাছাকাছি দক্ষিণ কোয়েটার মান্দ এলাকার একটি গণকবরে। তার মা বিবিসিকে বলেন, ‘পুলিশকে বারবার অনুরোধ করার পরেও তারা আমার ছেলের বিষয়ে কোনও অভিযোগ নেয়নি।’ বেলুচ সরকারের বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করে একটিও নিখোঁজ লোকের সন্ধান মেলেনি বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়।

২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর বেলুচিস্তানে মানবিক বিপর্যয়ের আসল চেহারাটি বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসতে সক্ষম হন বেলুচিস্তানের ২৬ বছরের এক তরুণী ফারজানা মজিদ বেলুচ। তিনি বর্তমানে ভয়েস ফর বেলুচ মিসিং পার্সনের (ভিবিএমপি) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। ফারজানা মজিদের ভাই বেলুচ স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের নেতা জাকির মজিদকে ২০০৯ সালের ৮ জুন কোয়েটার মাসতাংয়ের একটি বিপণিবিতানের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় আইএসআইয়ের সদস্যরা। এর পর থেকে আজ অবধি নিখোঁজ তিনি।

ভাইকে ফিরে পেতে আন্দোলনে নামেন ফারজানা মজিদ। ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর তিনি যখন কোয়েটা থেকে ইসলামাবাদ অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করেন তখন তাঁর সঙ্গে মাত্র ১০ জন নারী আর তাদের শিশুসন্তানরা। তাদের সবার পরিবারের কেউ না কেউ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে নিখোঁজ হয়েছে। বেলুচিস্তান থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত তাদের এই পদযাত্রাকে দুর্গম করতে সব চেষ্টাই করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সাহায্যপুষ্ট বিভিন্ন সুন্নি জঙ্গি সংগঠন ও এজেন্টরা। কিন্তু পারেনি বেলুচ নারীদের যুদ্ধংদেহি মনোভাব, অটল সংকল্প আর বৈরি আবহে টিকে থাকার মতো অদম্য শক্তির কারণে। তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার যেন নিখোঁজ স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়। দিনের তীব্র গরম আর রাতের কনকনে শীত উপেক্ষা করে পদব্রজে তাদের অসম সাহসী পদক্ষেপ টনক নড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের। কারণ দু-তিন দিনের মধ্যেই তাদের যাত্রাসঙ্গী হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। তাদের প্রত্যেকেই নিজ পরিবারের কাউকে না কাউকে হারিয়েছে। কোয়েটায় শুরু হওয়া তাদের ক্ষীণকণ্ঠের প্রতিবাদ ইসলামাবাদে এসে লাখো কণ্ঠের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। তখনই পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বেলুচিস্তানে ৮০ বছর ধরে চলে আসা গণহত্যা, গুম, খুন ও নারী নিপীড়নের আসল চিত্র। হেঁটে এক হাজার ৩৫০ মাইল পথ পাড়ি দেওয়া এই দীর্ঘ যাত্রাটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিবাদের পদযাত্রার প্রতীক হয়ে ওঠে। ফারজানা মজিদ বর্তমানে আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। সম্প্রতি সেখান থেকেই তিনি বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকে বেলুচিস্তানেও তা-ই হয়ে আসছে। ১৯৪৮-এর পর ১৯৫৮-৫৯, ১৯৬২-৬৩ এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ এবং সর্বশেষ ২০০০ সাল থেকে আজ অবধি দেড় শর বেশি সেনা অভিযান পারচালিত হয়েছে বেলুচিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, বসতবাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে; মেয়েদের তুলে নেওয়া হচ্ছে।

২০১৭ সালে স্কাইপে স্বাক্ষাতকার দিয়েছিলেন কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়া বেলুচ ছাত্র সংস্থার (বিএসও আজাদ) চেয়ারম্যান বানুক করিমা বেলুচ। সেসময়ে তিনি বলেছিলেন,যুবসমাজ যুগ যুগ ধরে বেলুচিস্তানের মুক্তির আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ কারণেই তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় টার্গেটে পরিণত হয়েছে। গত ১৬ বছরে কয়েক হাজার ছাত্রকে গুম করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তাদের খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। যুবসমাজের পাশাপাশি নারীরাও মুক্তিসংগ্রামে শামিল হয়েছে। তারাও আইএসআই বা তাদের সমর্থনপুষ্ট ইসলামী জঙ্গিদের রোষানলে পড়েছে। এ ছাড়া শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী-যিনিই পাকিস্তানের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তিনি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্মম নিগ্রহ ও হত্যার শিকার হচ্ছেন।

এছাড়াও, প্রদেশিক সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবেই কাজ করে। কারণ কয়েক যুগ ধরে কোনো প্রাদেশিক সরকারই বেলুচদের ভোটে নির্বাচিত হয়নি। প্রহসনের নির্বাচন দিয়ে সেনাবাহিনীর পছন্দের লোকদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। এ কারণে তারাও কখনো বেলুচিস্তানের গণহত্যার বিপক্ষে একটা কথাও বলেনি। বরং তারা সমর্থন দিয়েছে। বালুচিস্তানে পাকিস্তানি সেনার নৃশংসতাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) বেলুচিস্তানের অভিশাপ এবং চীন-পাকিস্তান সেনা চুক্তি আখ্যা দিয়ে বানুক করিমা বলেছিলেন, ৪৫ বিলিয়ন ডলারের এই চুক্তি বেলুচিস্তানের জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে করা হয়েছে। চুক্তিতে যা আছে তা কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। পাকিস্তানের সিভিল সরকারও বোধ হয় জানে না ওই চুক্তিতে কী আছে। কারণ চুক্তি বাস্তবায়নের পুরোটাই সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত। তিনি বলেন, গোপন মাধ্যমে যেটুকু জেনেছি, এই চুক্তি বেলুচিস্তানের নিজ ভূমিতে তাদের সংখ্যালঘু বানানোর ষড়যন্ত্র। চীন বেলুচিস্তানে একটি সেনা পোতাশ্রয় নির্মাণ করবে এবং গাওদর বন্দর থেকে সড়কপথে পশ্চিম চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের কাশহার পর্যন্ত সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এখানকার যত প্রাকৃতিক সম্পদ আছে তা গাওদর বন্দরের মাধ্যমে চালান হয়ে যাবে অন্যত্র। এখানে পাঞ্জাব ও সিন্ধের জনগণকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যার পুরোটাই বেলুচিস্তানের জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে।

বানুক করিমা আরো বলেন, গাওদর বন্দরের জন্য ইতিমধ্যে হাজার হাজার বেলুচকে তাদের ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা এখনো আছে তাদেরও নিজ বাড়িতে ফিরতে অনুমতি নিতে হয়। কত দিন এসব সহ্য করবে বেলুচিস্তানের জনগণ! তিনি বলেন, সিপিইসিকে বাস্তবায়ন করতেই বেলুচিস্তানের অভ্যন্তরে সিপিইসি প্রকল্প এলাকাগুলোতেই বিগত কয়েক যুগে সবচেয়ে বেশি সেনা অভিযান পরিচালিত হয়েছে । আর এসব অভিযানের লক্ষ্য একটাই-তা হলো এই অঞ্চলকে বেলুচশূন্য করা।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে, করিমাকে টরন্টোতে নিখোঁজ হওয়ার দিনেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স (আইএসআই)-কে ব্যবহার করে পরিকল্পিত ভাবে তাঁকে খুন করা হয়েছে বলে দাবি জানিয়ে আসছে স্বাধীন বালুচিস্তানের দাবিতে সরব হওয়া একাধিক সংগঠন।