গ্লোবাল সাউথের নেতা হিসাবে আবির্ভূত ভারত | BD Times365 গ্লোবাল সাউথের নেতা হিসাবে আবির্ভূত ভারত | BdTimes365
logo
আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১৫:৫৫
সদ্য সমাপ্ত জি-২০ সম্মেলন: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
গ্লোবাল সাউথের নেতা হিসাবে আবির্ভূত ভারত

গ্লোবাল সাউথের নেতা হিসাবে আবির্ভূত ভারত

সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন

ভারতে সদ্য শেষ হল জি ২০ সম্মেলন। 'এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যত' শীর্ষক স্লোগানকে নিয়ে এই সম্মেলনের দৃষ্টি ছিল বিশ্বের উদীয়মান দেশগুলির খাদ্য নিরাপত্তা, সরবরাহ শৃঙ্খল সমস্যা, জ্বালানী শক্তি এবং প্রযুক্তি সহ বিভিন্ন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহযোগিতা। বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮০ শতাংশই জি ২০ জোটভুক্ত দেশগুলোর দখলে। আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশের সঙ্গে জড়িত জি–২০ দেশগুলো। যে কারণে এ ইভেন্টটি ছিল বিশ্বের প্রধানতম আন্তদেশীয় সম্মেলন। যে কারণে শুরু থেকেই বিশ্বের তাবৎ পর্যবেক্ষক কুটনৈতিক বিশ্লেষকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই সম্মেলন। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ব মন্দা, চীন আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি, তাইওয়ানে চীনের যুদ্ধ মহড়া এত কিছুর মধ্যে এই সম্মেলনটি সুষ্ঠুভাবে শেষ হওয়া নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠাও ছিল। বিশেষত ভারতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন নিয়ে ছিল অনেক জল্পনা কল্পনা। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে বেশ চমৎকার ভাবে সম্পন্ন হলো সম্মেলনটি যা বিশ্বমঞ্চে ভারতের বিজয় মুকুটে এক নতুন পালক যুক্ত করেছে। দেশে বিদেশে মোদি সরকারের ব্যাপক সমালোচনার পুরোন গল্প ছাপিয়ে তাঁর নেতৃত্বে সফলভাবে শেষ হওয়া সম্মেলনের জন্য প্রশংসাংয় ভাসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এমনটাই বলছেন কুটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ইউএস-ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পার্টনারশিপ ফোরামের প্রেসিডেন্ট মুকেশ আঘির মতে, নয়াদিল্লিতে শেষ হওয়া জি-২০ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের কূটনৈতিক দক্ষতা একটি সফল মাইলফলক স্পর্শ করেছে। ভারতের এই সাফল্য চীনের জন্যও বেশ বড়সড় এক ধাক্কা হিসেবে মন্তব্য করেন তিনি। তাঁর মতে, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গ্লোবাল সাউথের নেতা হিসাবে ভারত তার অবস্থানকে আরও পাকাপোক্ত করলো। তিনি বলেন, সম্মেলনে চীন তার রাষ্ট্রপতিকে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের সাফল্যের একটি স্পষ্ট সূচক। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, শীর্ষ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অনুপস্থিতি একদিকে ভারতের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল। তিনি মনে করেন শি এর অনুপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও যৌথ এজেন্ডা আরও কার্যকরভাবে চালিত করতে এবং একটি একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী গ্রুপ অব টোয়েন্টি বা জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশকে ‘অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র’ হিসাবে উচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। জি ২০ গ্রুপের সদস্য না হয়েও দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র ‘অতিথি দেশ’ এর মর্যাদা ছিল বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের। বিশ্লেষকদের মতে, জোটে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগের সম্পর্ক আরও জোরদার করার লক্ষ্যে এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাওয়া এবং তাতে যোগদান একটি যুগান্তকারী ঘটনা। সেখানে বিশ্বের অন্যতম নেতাদের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেছেন যা বাংলাদেশে তার শক্তিশালি অবস্থানকেও আরও সুসংহত করেছে বলে মনে করছেন অনেকে। সম্মেলনের বিভিন্ন পর্যায়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে বিশ্ব নেতাদের একান্ত বৈঠকের বিষয়টিও বাংলাদেশও গুরুত্ব পেয়েছে। সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিশ্বনেতাদের সামনে বাংলাদেশের গুরুত্বকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফল হয়েছেন বলে মনে করছেন কুটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

শুধু বাংলাদেশেই নয়; নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে জি-২০ সম্মেলনে আফ্রিকার অন্তর্ভুক্তির বিষয়েও এডভোকেসী করেছে ভারত। ভারতের প্রস্তাবনায় জি ২০ কে আরও শক্তিশালী করতে, ৫৫ সদস্যের আফ্রিকান ইউনিয়নকে (এ.ইউ) আনুষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইউ) সমতুল্য মর্যাদা দেওয়া হয় এ.ইউকে। আগে আফ্রিকা থেকে  শুধুমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকাই জি-২০ এর সদস্য ছিল। অনেকদিন ধরেই আফ্রিকা তার বিশাল সম্পদ এবং বাজার সম্ভাবনার কারণে বৈশ্বিক মঞ্চে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছিল। জি-২০ গ্রুপে আফ্রিকান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তি, এটিকে কার্যকরভাবে জি-২১ এ রূপান্তরিত করে গ্লোবাল সাউথের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ভারতের অবস্থানকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করেছে। এছাড়াও ইউক্রেন সম্পর্কিত বিতর্কিত ধারাগুলিতে ঐকমত্য অর্জনে ভারতের ভূমিকার পাশাপাশি, আফ্রিকান ইউনিয়নকে স্বাগত জানানোয় ভারতের কূটনৈতিক দক্ষতা প্রশংসা কুড়িয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন যে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, বহু-জাতি গোষ্ঠীর "আফ্রিকান ইউনিয়নকে পূর্ণ সদস্য করে" ভারত তার দক্ষতা প্রমাণ করেছে।

সুদূরপ্রসারী ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবসহ একটি যুগান্তকারী উন্নয়নে জি-২০ সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব এবং ভারত মিলে একটি নতুন বাণিজ্য রুট বা করিডোর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোকপাত করেছে। প্রস্তাবিত রুটের লক্ষ্য তেল সরবরাহের জন্য পারস্য উপসাগর এবং দক্ষিণ এশিয়াকে স্থল ও সমুদ্রপথে সংযুক্ত করা। সমাপনী ভাষনে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, সকলের জন্য একটি অনুকূল বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য, জি-২০ সম্মেলন সুরক্ষাবাদ এবং বাজার-বিকৃতি চর্চাকে নিরুৎসাহিত করে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং ন্যায়সঙ্গত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। প্রস্তাবিত ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোরের বিষয়ে তিনি বলেছেন ‘এটি আগামী শতাব্দীর জন্য বিশ্ব বাণিজ্যের প্রধানতম কেন্দ্র হয়ে উঠবে, এবং ইতিহাস সর্বদা মনে রাখবে যে এই করিডোরটি ভারতের মাটিতে শুরু হয়েছিল।"

এবারের জি ২০ সম্মেলনে ভারতের পর্যটন শিল্পের এক যুগান্তকারী ধারা বিকশিত করেছে বলে মনে করছে ভারত। সম্প্রতি এক স্বাক্ষাতকারে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন "পর্যটন শিল্পের উন্নতির ক্ষেত্রে যে কোনো দেশের প্রতি সদিচ্ছা এবং আকর্ষণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক বছরে ভারতের প্রতি মানুষের আগ্রহ অনেক বেড়েছে। এখন যেহেতু জি-২০ সফলভাবে সংগঠিত হয়েছে, বিশ্ব সম্প্রদায় এখন আরও বিশদভাবে ভারত সম্পর্কে জানতে চায় ৷ সম্মেলনে যোগ দিতে এক লাখেরও বেশি মানুষ ভারতে এসেছিল৷ এখানে আসার সাথে সাথে তারা আমাদের ইতিহাস, বিভিন্ন ঐতিহ্য এবং বিভিন্ন ধরণের খাবার সম্পর্কে জানতে পেরেছে। এখানে আসা অতিথিরা যে চমৎকার অভিজ্ঞতা তাদের সাথে নিয়ে যাচ্ছেন তা ভবিষতে ভারতের পর্যটন শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সম্মেলনে জি-২০ ট্যুরিজম ওয়ার্কিং গ্রুপের তৃতীয় বৈঠকটির আয়োজন করা হয়েছিল কাশ্মিরে। এটাকে এক দারুন কৌশল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বোঝাতে পেরেছে যে জম্মু ও কাশ্মিরের জীবনধারা এখন স্বাভাবিক। জি ২০ সম্মেলনে কাশ্মিরে পর্যটনকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করতে ভারতের একটি বড় প্রচেষ্টা ছিল। যা কার্যত অনেকটাই সফল হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। এ কারণে জম্মু কাশ্মিরে বিনিয়োগের সুযোগগুলো খতিয়ে দেখতে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে মধ্যপ্রাচ্যের কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ, প্রবাসী, ব্যবসায়ী এবং কূটনীতিকরা জম্মু ও কাশ্মীর সফর করেছেন।

মুকেশ আঘি মনে করেন, আন্ত দেশীয় বানিজ্য, সুযোগ, প্রতিরক্ষা এবং উন্নয়ন মহাসড়কে উঠে আসা দেশগুলির প্রতি সহানুভূতি ও সংবেদনশিলতা এসব নানা বিষয়ে এবারের জি-২০ সম্মেলনে ভারত বেশ দক্ষতা দেখিয়েছে। এসব কারণে গ্লোবাল সাউথের জন্য একটি দৃঢ় কণ্ঠস্বর হিসাবে ভারতকে নেতৃত্বস্থানীয়  নতুন ভুমিকায় দেখা গেছে। তিনি বলেন, ‘ভারত একটি উদীয়মান শক্তি এবং বহু আগেই অনেকে ভবিষ্যতবানী করেছিলেন যে  ভারত একদিন মহা শক্তিধর দেশে পরিণত হবে ৷ সদ্য শেষ হওয়া জি-২০ সম্মেলনে ভারতের কূটনৈতিক দক্ষতা থেকে বোঝা যাচ্ছে ভারত এখন মহাশক্তিধর দেশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।