ডেঙ্গু নির্মূল করবে কে? | BD Times365 ডেঙ্গু নির্মূল করবে কে? | BdTimes365
logo
আপডেট : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১৭:৪৪
ডেঙ্গু নির্মূল করবে কে?
সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন

ডেঙ্গু নির্মূল করবে কে?

ডেঙ্গুর উপদ্রব এখন আর শুধু রাজধানী ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই, ছড়াচ্ছে গ্রামেও। শহরে তো আছেই, যথাযথ চিকিৎসা না থাকায় প্রতিদিনই গ্রাম থেকে ডেঙ্গু রোগীরা ভিড় জমাচ্ছে ঢাকায়। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী উপচে পড়ছে। রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন ডাক্তার ও নার্সরা।

প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে মৃত্যু হচ্ছে। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর তালিকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে, বিশেষ করে, রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। সবশেষ ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬৯১ জন।

চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৩৮ হাজার ২২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৬৩ হাজার ২৭৩ ও ঢাকার বাইরে সারা দেশে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৭৪ হাজার ৭৪৯ জন।

 

শুধু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ওপর ভর করে এমন তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে বাস্তব চিত্র এর চেয়েও ভয়াবহ। আসলে ভয়াবহ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অনেকে হাসপাতালে না গিয়ে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। তাদের হিসাব অধিদপ্তরের তথ্যে আসে না।

সব মিলে সমগ্র দেশজুড়েই ভয়াবহ আকার নিয়েছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে বাংলাদেশকে।

বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ চলছে। দিনে দিনে এর প্রকোপ বেড়ে চলেছে। অথচ এই রোগের বাহক এডিস মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ বলতে গেলে কেবল বক্তব্য-বিবৃতি আর কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কেবলই একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছেন।

প্রশ্ন উঠেছে- ক্রমে মহামারি হয়ে ওঠা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দায়টা কার? মশা নিধন অভিযান নিয়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নির্মূলে ব্যর্থ হয়েছে।

এডিস মশা নির্মূলে দুই সিটি করপোরেশনকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। জোরালো করতে হবে মশক নিধন অভিযান। সর্বোপরি সমস্যা থেকে উত্তরণে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়াটা জরুরি।

 

ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবার ভয়াবহ আকার ধারণ করার পর নড়েচড়ে বসেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্তারা। এরপরই বেরিয়ে আসতে থাকে রাজধানীর মশা নিধনে ব্যর্থতার নেপথ্যের কারণ।

সম্প্রতি ঢাকায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে এক বিশাল প্রকল্প জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে গত ৫ বছর ধরে আইনের মারপ্যাচে ফেলে সিন্ডিকেট তৈরি করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেদারসে নিম্নমানের বালাইনাশক সরবরাহ করে যাচ্ছে। হাতেগোনা ওই চার/পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি হয়ে আছে রাজধানীর মশক নিধন ব্যবস্থা।

সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কাগজপত্র জালিয়াতি করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) জন্য বিটিআই (এডিসের লার্ভা নির্মূলে ব্যবহার হয়) আমদানি করেছিল। ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ না করায় আগেও প্রতিষ্ঠানটিকে সিটি করপোরেশন থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এবার প্রতিষ্ঠানটি চীন থেকে বিটিআই আমদানি করলেও এটির মোড়কে প্রস্তুতকারক হিসেবে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেডের নাম উল্লেখ করে। পরে সিঙ্গাপুরের ওই কোম্পানি নিজেদের ফেসবুক পেজে বিষয়টি দৃঢ়ভাবে নাকচ করে। এতেই বেরিয়ে আসে থলের বেড়াল।

জানা গেছে, ৭ আগস্ট মার্শালের আমদানি করা মশা নিধনে বিটিআইয়ের প্রয়োগ শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। সেদিন ডিএনসিসির অঞ্চল-৩-এর আওতাধীন গুলশান-২ নম্বরের ৪৭ নম্বর সড়ক এলাকায় এ কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। ওই সময় সেখানে লি শিয়াং নামের এক ব্যক্তিকে বিটিআই কীটনাশকের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের পক্ষ থেকে। অথচ ওই ব্যক্তিও ছিলেন ভুয়া। পরে ওই ব্যক্তিকে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল তাদের কর্মী এবং কীটনাশক বিশেষজ্ঞ নন বলে জানায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দরপত্রের নথিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে বিটিআই অবশ্যই আমেরিকা, ইউরোপ, সিঙ্গাপুর, ভারত অথবা মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করতে হবে। কিন্তু মার্শাল সিঙ্গাপুর থেকে বিটিআই কীটনাশক আমদানি করেনি, যেমনটি তারা দাবি করেছিল। এ ধরনের কীটনাশক আমদানির লাইসেন্স দেয় কৃষি বিভাগের উদ্ভিদ সুরক্ষা উইং (পিপিডব্লিউ)।

ডিএনসিসি ও পিপিডব্লিউ কর্তৃপক্ষই নিশ্চিত করেছে, বিটিআই আমদানি করা প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এই লাইসেন্স নেই। কাস্টমস নথি অনুসারে, এটি শানডং গ্যানন অ্যাগ্রোকেমিক্যাল নামে একটি চীনা কোম্পানি থেকে আমদানি করা হয়েছে। লি শিয়াং ওই প্রতিষ্ঠানেরই একজন প্রতিনিধি।

এই অপরাধের দায়ে ২৩ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দর থানায় চট্টগ্রাম কাস্টমসের পক্ষ থেকে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক এম নাসিরউদ্দিন আহমেদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে। তবে এত কিছুর মধ্যেও ২৮ আগস্ট ডিএনসিসির পক্ষ থেকে ঘটা করে জানানো হয় যে, জালিয়াতি করে আমদানি করা ওই বিটিআই এডিসের লার্ভা নিধনে কার্যকর।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, ‘এডিস মশা বিস্তারের যে অবস্থা, তাতে এই মুহূর্তে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিটিআই খুব একটা কার্যকর হবে না। এটি কিউলেক্স মশার বিরুদ্ধে বেশি কার্যকর। লার্ভিসাইড যদি এডিস মশার উৎপত্তিস্থলে না পৌঁছায়, তবে তা দেয়া না দেয়ার শামিল। ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পেতে অবশ্যই এডিসের আবাসস্থল ধ্বংস করতে হবে।’

প্রতি বছর সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম এবং চিরুনি অভিযানের মতো নতুন উদ্যোগের কথা ফলাও করে প্রচার করে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, পাড়া-মহল্লায় ফগার মেশিনের শব্দও শোনা যায়। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা মশার বংশবিস্তার রোধে যে তেমন ফলদায়ক হয়নি, ডেঙ্গুর ভয়াবহতাই তা প্রমাণ করে।

কীটতত্ত্ববিদদের মতে, শস্যের পোকামাকড় নিধন আর মশা নিধনে ওষুধ প্রয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এডিস মশা নিধনে ওষুধের সঠিক মাত্রা নির্ধারণ ও তার প্রয়োগ সঠিকভাবে করা হয়নি। পুরো বিষয়টি মনিটরিংয়ের দুর্বলতাও লক্ষণীয়। এ কারণে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতা সিটি কর্তৃপক্ষ এডিস মশা নির্মূলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এডিস নিয়ন্ত্রণে দেখা যায় উল্টো চিত্র। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কাজ না করে এলোমেলো কিছু মৌসুমী প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না।

যে মুহূর্তে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ঢাকার সিটি করপোরেশনগুলোর বিপরীতধর্মী অবস্থান এক কথায় অযৌক্তিক।

এছাড়াও কয়েক বছর ধরে মশা নিধনের নামে সিটি করপোরেশনে যে হরিলুট চলে সেই সংস্কৃতিও বন্ধ হওয়াটা জরুরি। বড় বড় প্রতারণা করে পার পেয়ে যাওয়া, কর্তাব্যক্তিদের দায়সারা পদক্ষেপ এবং একে অন্যের ওপর দায় চাপানোটা কোনো সমাধান নয়।

দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আর দিনের পর দিন দুর্নীতি করেও কোনো শাস্তি না পাওয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতির সিন্ডিকেট ডালপালা ছড়িয়েছে। সেই ডালপালাও ছেঁটে ফেলতে হবে। দুর্নীতিতে যুক্ত সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীলদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। মশার ওষুধ সরবরাহকারীদের শাস্তি দিলেই হবে না। এদেরকে যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, এসব কাজে অনুমোদন দিচ্ছেন, তাদেরও বিচার হওয়া জরুরি।