পিঠায় বাঙালির রসনাবিলাস | BD Times365 পিঠায় বাঙালির রসনাবিলাস | BdTimes365
logo
আপডেট : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ১২:২৩
পিঠায় বাঙালির রসনাবিলাস
পিঠার ব্যবসা করে পুরুষদের ছাপিয়ে অনেক নারীই আজ ঘরের কর্তা। বড় বড় পিঠার দোকান অনেকের জন্য তৈরি করছে কর্মসংস্থান।
মিঠু পাল, বিডিটাইমস৩৬৫ডটকম

পিঠায় বাঙালির রসনাবিলাস

পিঠাকে কেন্দ্র করে শহুরে শীত যেন চলে আসে হেমন্তেই। এসময় থেকেই ঢাকার ফুটপাত ছেয়ে যায় বাহারী পিঠার দোকানে। সময়ের সঙ্গে পিঠা এখন হেসেলের নারীকেও সম্পৃক্ত করেছে অর্থ উপার্জনের সঙ্গে। দিয়েছে সাম্বলম্বী হওয়ার হাতিয়ার। অনেক নারী এই ক্ষুদ্র ব্যবসাকে পুঁজি করেই চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের সংসার। চলছে সন্তানের লেখাপড়া, পরিবারের ভরণ-পোষণও।

বাঙ্গালীর রসনাবিলাসের এক অনবদ্য শৈল্পিক উদাহরণ পিঠা। নানা উৎসবে আয়োজনে পিঠার প্রচলনটা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। বিশেষ করে শীতকাল আসলেই ঘরেবাইরে বাহারি পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়। অবশ্য গ্রামে রান্নাঘরে পিঠা যতটা দেখা যায় ইট-কাঠ-পাথরের শহুরে জীবনে ততটা চোখে পড়ে  না। ঢাকা শহরে এখন আর ঘটা করে বাসা বাড়িতে কেউ পিঠা বানায় না। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা এই শহুরে জীবনে ঘরে পিঠা বানানো কয়টা পরিবারের পক্ষে সম্ভব তাও প্রশ্নবিদ্ধ। সবাই এখন শীতের পিঠার উৎসবে মাতে কেনা পিঠার ওপর ভর করেই।

পরবর্তী গরমকাল না আসা পর্যন্ত চলে পিঠার ব্যবসা। ব্যবসা-ই বটে। স্বল্প পুঁজিতে বেশ ভালই ব্যবসা চলে শীতের পিঠাকে ঘিরে। কুটিরে গড়ে ওঠা এই পারিবারিক শিল্পকে শহুরে জীবনে একটা সামজিক ব্যবসাও বলা যায়।

কম পুজির এই ব্যবসা বেশ লাভজনক। হাতিরঝিল ও মগবাজার এলাকার অনেকগুলো ভাসমান পিঠার দোকান ঘুরে দেখা যায় ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। দোকানিরাও বেশ ব্যস্ত।

হাতিরঝিলের ফুটপাতে পিঠা ‍বিক্রি করেন মোসা. হালিমা বেগম। বিডিটাইমস৩৬৫ ডটকমের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। জানালেন ব্যবসা বেশ ভালই চলছে।

পুরো পরিবার তার এই উপার্জনে চলে।দুই ছেলে আর এক মেয়ে সন্তান তার। স্বামী কি করে জানতে চাওয়া মাত্রই হালিমা বেগমের সাদামাটা মুখটায় রাজ্যের আঁধার নেমে আসে। তিনি জানান, ‘বাবা দুঃখের কথা আর কি কমু! আমার জামাই রিক্সা চালাইতো, আয় রোজগার ভালোই আছিলো। তয় বছর তিনে আগে অসুখ হইয়া এহন বিছনায়। কোন কাজ বাজ করে না। আমার এই পিডার ব্যবসা দিয়া যা রোজগার, আল্লায় দিলে এইয়া দিয়াই চইল্লা যায়। আর পোলাপান দুইডা স্কুলে যায় তো, খরচ চালাইতে একটু কষ্ট হয়’।

তিনি শুধু ভাপা পিঠা বিক্রি করেন। প্রতিদিন যে পরিমান পিঠার চালের গুড়ো, নারিকেল ও গুড় নিয়ে আসেন তা বিক্রি হতে বেশী সময় লাগে না।

পুঁজি সম্পর্কে জানতে চাইলে হালিমা জানান, শুধু ভাপা পিঠার ব্যাবসা করতে খুব বেশী পুঁজির দরকার হয় না।

তিনি বলেন, ‘প্রতি কেজি গুড়ো চাল ৪০ টাকা, নারিকেল প্রতি পিস ৬০ থেকে ৮০ টাকা, গুড় প্রতি কেজি ৬০ টাকা। এছাড়া প্রতিদিন এক থেকে দেড় লিটার কেরোসিন তেল লাগে’।

সব মিলিয়ে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পুঁজি খাটালে এ ব্যাবসা বেশ ভালো ভাবে করা যায় বলেও মত দেন তিনি।

ব্যাবসার লাভ সম্পর্কে তিনি বলেন, “মামা ভাপা পিডা বানাইতে অনেক ঝামেলা। তার পরেও যা ব্যবসা হয় এক্কেরে খারাপ না। ১০ টাহা কইরা বেঁচি একেকটা। থাহে একেকটায় ৪/৫ টাকা।’

ফুটপাতে পিঠার দোকান কে বসিয়েছে বা কিভাবে তিনি এখানে বসেছেন- জানতে চাইলে তিনি জানান, তার বাসা হাতির ঝিলের পাশেই। তিনি নিজেই এখানে বসেছেন। কেউ তাকে বসায়নি।

যেহেতু ফুটপাতে ব্যাবসা সেক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যাক্তি, রাজনৈতিক নেতাদের ঝামেলা অথবা চাঁদা দেওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে হালিমা বলেন, ‘হাতিরঝিলে পুলিশ, নেতার কোন ঝামেলা নাই,আর কাউকে চাঁদাও দিতে হয় না।’

হালিমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই দোকানের পিঠা খেতে আসেন এক ভদ্রলোক। বেশ পরিপাটি চেহারার লোক। কথা বলে জানা গেলো তার নাম আরিফুর রহমান। একটি বেসরকারী অফিসে কাজ করেন তিনি। জানতে চাইলাম, পিঠা কি প্রাই খাওয়া হয় না কি আজই প্রথম খেতে আসলেন? উত্তরে জানালেন, শীতকালের সময়টায় প্রতিদিনই তিনি পিঠা খান।

বললেন, ‘ভাই বাড়ীতে বানানো মায়ের হাতের পিঠার স্বাদ তো আর এ সব দোকানে পাওয়া যাবে না। তারপরেও হালকা নাস্তা হিসেবে খাই। বেশ ভালোই লাগে।’

তৈলাক্ত খাবারের চেয়ে এই পিঠা অনেকগুন ভালো বলেও মত দেন তিনি।

এই পিঠা দোকান যেমন ব্যক্তিকে স্বালম্বী করছে তেমনি করছে কর্ম সংস্থানও। ছোট পরিসরে চলা গত প্রায় এক দশকের ওই ব্যবসা এখন পশ্চিমা স্ট্রিট ফুডের বাঙালি সংস্করণ। এ রকম পিঠার দোকান একটু শীত এলেই ঢাকা শহরের অধিকাংশ রাস্তার পাশে বসে যায়।

মগবাজার মোড়ের পিঠা ব্যাবসায়ী আ. সত্তারের সঙ্গেও কথা হয় বিডিটাইমস৩৬৫ ডটকমের এই প্রতিবেদকের।

চিতই, ভাপাসহ আরো তিন-চার ধরনের পিঠা বানান তিনি। পিঠা খাওয়ার জন্য সুঁটকি ভর্তা, ষরিষা ভর্তা, ধনেপাতা ভর্তা ও কাঁচামরিচ ভর্তার ব্যাবস্থাও আছে তার দোকানে। রাস্তার এক পাশের বেশ বড়ো অংশ জুড়ে তার দোকান। পিঠা বানানোর জন্য নিয়োগ দিয়েছেন আরও তিনজন লোক।

দুই টাকার চিতোই পিঠা থেকে শুরু করে বিশ টাকা পর্যন্ত পিঠা তার দোকানে পাওয়া যায়।

এক ক্রেতা দুই টাকার ৩০টি পিঠার অর্ডার দিয়েছেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো এই পিঠাগুলি নিয়ে মিষ্টির সিরার মধ্যে ভিজিয়ে রাখবেন তিনি। পরে পরিবারের সবাই মিলে খাবেন।

বিডিটাইমস৩৬৫ ডটকমকে তিনি আরো বলেন, “বাসায় সবার ব্যাস্ততা, আর পিঠা বানাতে এতো সব ঝামেলার কারণেই দোকান থেকে প্রায়ই পিঠা কিনে নিয়ে খাওয়া হয়। এতে যেমন সময় বাঁচে, তেমনি বাড়তি ঝামেলাও পোহাতে হয় না।”

দোকানি সত্তারের দাবি, তার পিঠার দোকান এই এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। প্রতিদিন সব মিলিয়ে আট থেকে দশ হাজার টাকার পিঠা বিক্রি হয়।

লাভের কথা জিজ্ঞাসা করতেই একটা হাঁসি দিয়ে বললেন, “ভাই লাভ হয় আর কি! থাকে কোন রকম। দশ হাজার টাকা বেচতে পারলে তিন-চার হাজার থাকে।”

ব্যাবসার মূলধন হিসেবে চার হাজার টাকার মালামাল কিনে শুরু করেন এ ব্যাবসা।এখন ছত্তার সাহেবের ছয় জনের পুরো পরিবার এই ব্যাবসার উপরই নির্ভরশীল।তার চার ছেলে মেয়ের মধ্যে এক ছেলে কলেজে পড়াশুনা করেন।বাকী তিন জন স্কুলে।নির্ভরশীল তার দেকানে কাজ করা তিন সহযোগীর পরিবারও।

প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে তার দোকান। দুপরের সময় বিক্রি একটু কম হওয়াতে দোকান বন্ধ রাখেন বলে জানান।

রাস্তার পাশে তার দোকানকে বসিয়েছে এ প্রশ্ন করা হলে উত্তরে জানান, এখানকার স্থানীয় এক লোক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বসিয়েছে। সে জন্য প্রতিদিন তাকে ১০০ টাকা দিতে হয়।

পুলিশি কোন ঝামেলার কথা জানতে চাইলে সত্তার বলেন, “পুলিশ তেমন কোন ঝামেলা করে না। তবে যেসব পুলিশ ডিউটিতে থাকে তারা যদি কোন পিঠা খায় সে ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে কোন টাকা নেয় না।”

আমাদের বাবা বা দাদারা কি তাদের যৌবনে কখনো ভাবতে পেরেছিলেন এই পিঠা একদিন বাসা বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে ব্যাবসার উপকরণ হয়ে উঠবে? মানুষ এটার উপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করবে... !

হুম! সেটাই হয়ে উঠেছে। পিঠা এখন একটা ব্যাবসার উপকরণও বটে।

ঢাকা শহরে অনেকেই এই পিঠাটাকে ব্যাবসা হিসেবে বেঁছে নিযেছেন। বিশেষ করে বেশিরভাগ নারীরাই পিঠা বিক্রিকে পেষা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। এতে আমাদের নারী সমাজ যেমন হচ্ছে স্বাবলম্বী তেমনি পরিবারগুলো করতে পারছে বাড়তি উপার্জন। এমন কি আনেক নারী পিঠার ব্যাবসা করে পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে সংসারের হাল ধরার মত কাজ করে যাচ্ছে বেশ দক্ষতার সাথে।

তবে এসব পিঠার দোকানগুলো রাস্তার পাশের খোলামেলা পরিবেশে হওয়ায় পিঠার সঙ্গে অতিরিক্ত বোনাস হিসেবে আমরা খাচ্ছি ধূলোবালি। আর অনেক পিঠার দোকানী আছে যারা পিঠার রং সাদা করার জন্য ব্যাবহার করেন সোডা ও নানা ধরনের ক্যামিকেল। যেগুলো আসলে আমাদের শরীরের জন্য মারাত্মক ভাবে ক্ষতিকর।

উপায় তো আর নেই। পূর্বপূরুষের রসনা বিলাসের যে আভিজ্ঞতা আমার পেয়েছে তাকি বার ভোলা যায়। পিঠাতো খেকেই হবে। না হলে বুঝবো কিকরে শীত এসেছে! তাই খেয়েই চলেছি।

বিডিটাইমস৩৬৫ ডটকম/এমপি/একে