মিষ্টি মহলের আনাচে কানাচে | BD Times365 মিষ্টি মহলের আনাচে কানাচে | BdTimes365
logo
আপডেট : ১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ২১:৪১
মিষ্টি মহলের আনাচে কানাচে
খ্যাতিমানেরা কি স্বল্পখ্যাতদের দমিয়ে দেয়? না না, মনুষ্য সম্পর্কিত উপলব্ধি নয়। মানবজমিন নিয়ে চাষবাস রামপ্রসাদ সেন, শীর্ষেন্দুবাবুরাই করুন। এ নেহাতই মিষ্টি-কথা। মানে মিষ্টির কথা।
অনলাইন ডেস্ক

মিষ্টি মহলের আনাচে কানাচে

হালের রসগোল্লা বা ক্ষীরমোহন নিয়ে বাংলা-ওড়িশার দ্বৈরথে কথাটা হঠাৎ মনে হল। বাঙালি মিষ্টি মানেই রসগোল্লা না হয় মিষ্টি দই। বলিউডি তারকারা এ রাজ্যে এলে হোমওয়ার্ক করে আসেন। আর সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ‘হামি রসগোল্লা আর মিষ্টি দোই বালবাসি।’ যেন রসগোল্লা ছাড়া বাংলায় আর কোনও মিষ্টি মেলে না। ব্যক্তিগত মত, রসগোল্লার জন্য বাঙালির হেদিয়ে মরার প্রাবল্যে অনেক ভাল মিষ্টি সেই ভাবে প্রচার পায়নি। প্রচার আর বিপণনের অভাবে তারা স্থানীয় মিষ্টি হয়েই রয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ হারিয়ে গিয়েছে। শুধু হাতের নাগালের বাইরে থেকে যাওয়ায় বহু বাঙালির রসনা তাদের স্বাদ বঞ্চিত হচ্ছে। সেই রাগেই লেখার শুরুতে খ্যাতিমানদের একটু গাল দিয়ে নান্দীমুখ করে নিলুম।

আমি অবশ্য কিছুটা ভাগ্যবান। নানা কার্যকারণ সূত্রে বেশ কয়েকটি স্থানীয় মিষ্টিকে জিভের নাগালের মধ্যে আনতে পেরেছি। স্থানীয় মিষ্টির কথা যখন হচ্ছে তখন একেবারেই স্থানীয়ভাবে শুরু করা যাক।

হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর ব্লকের বাসিন্দা আমি। এই ব্লকেই আছে মাজু নামে একটি জায়গা। যেখানে পাওয়া যায় খইচুর নামে একটি মিষ্টি। নামটা প্রথম শুনেছিলুম আমাদের ইস্কুলের শিক্ষক গৌরবাবুর কাছ থেকে। পরে গিয়ে যখন খোঁজ নিয়েছিলুম তখন খইচুর তার কৌলিন্য হারিয়েছে। মাজু বাজারে একটা মাত্র দোকানের ময়লা শোকেসে পুরনো অ্যালুমিনিয়ামের ট্রে-শয্যায় শুয়ে হাঁফ ছাড়ছে। অথচ একসময় দারুণ নাম ছিল এই মিষ্টির। সারি সারি দোকান ছিল মাজুতে।
তখন হাওড়া-আমতা রুটে চলত স্যার বীরেন মুখার্জির ছোট রেল। সকলে মার্টিন রেল বলেই জানত। ওই রুটেই পড়ে মাজু। হকারেরা দোকানগুলো থেকে খইচুর কিনে ট্রেনে ফেরি করত। ১৯৭১ সাল নাগাদ বন্ধ হয়ে গেল মার্টিন রেল। মাজুও স্থানীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। খইচুরও। খদ্দেরের অভাবে দোকানগুলোও বন্ধ হতে শুরু করল। একটি দোকানই মাজুর মিষ্টির ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল। এখন সেটি আছে? আর তৈরি করে কিনা জানা নেই। ভাল ধানের (নামটা বলেছিলেন দোকান মালিক। এখন ভুলে গিয়েছি) খই, গুড়, সুগন্ধী মশলা দিয়ে তৈরি খইচুর। গোল্লা পাকানোর সময়ে কারিগরের হাতের তালুতে ঘি মেঘে নেন। খেতে অনেকটা জয়নগরের মোয়ার মতো। ও হ্যাঁ, জয়নগরের মোয়া খেয়েছি। তবে তা কলকাতা থেকে কেনা। সেগুলো জয়নগর জাতক না জগজীবনপুরের, তা জানি নে।

হাওড়ারই আমতায় পাওয়া যায় ভাল পান্তুয়া। বেশ নাম। খেতেও অন্যরকম। মোটেও বাজার চলতি পান্তুয়ার মতো থ্যাসথেসে নয়। ছালটা মোটা। সেই বর্মের গর্ভে এলাচদানা রসে ডুবে ঘাপটি মেরে বসে। এক দোকানদার জানিয়েছিলেন, তাঁরা পয়সা বাঁচানোর জন্য লোক ঠকান না। অন্য জায়গার পান্তুয়ার মতো নিভু নিভু আঁচে পান্তুয়া ভাজলে তাড়াতাড়ি লাল রং আসে বটে। কিন্তু পান্তুয়া নরম থাকে। একটু কাঁচা কাঁচা ধরনের। আর গনগনে আগুনে ভাজলে চামড়া মোটা হয়। কিন্তু ভেতরটা থাকে সাদা। প্রচলিত আছে, অনেককাল আগের পুরনো কারিগরদের হাতে তৈরি পান্তুয়া কানের কাছে নিয়ে নাড়ালে ভিতরে রসের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ পাওয়া যেত। এখন সেখানে অনেক নতুন দোকান হয়েছে। কিন্তু চরিত আর দেনেদের পুরনো দোকান থেকে কিনলেই ভাল জিনিসটা মেলে। ও হ্যাঁ, কিনতে গেলে সকালের দিকে যাওয়াই ভাল। পুরনো দোকানগুলোর পান্তুয়া দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়।

হাওড়ার বাইরের নামী মিষ্টি প্রথম চেখেছিলুম মালদায়। রসকদম্ব আর কানসাট। আম ছাড়াও এই দু’টো মিষ্টির বেশ নাম আছে। তখন সদ্য ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’-এর মালদা এডিশনে যোগ দিয়েছি। আমার সঙ্গে একই দিনে যোগ দিয়েছে শৌভিক বাগচী। কলকাতার ছেলে। বেশ খাদ্যরসিক। ও একদিন টেনে নিয়ে গেল ইংলিশবাজারে। আমাদের মেসবাড়িটা ছিল ওল্ড মালদায়। পুরসভা এলাকার একেবারে শেষে। পুরনো মালদা আর ইংলিশবাজারে মাঝে মহানন্দা। মাঝির গোনাগুনতি দুই লগির ঠেলায় সরু খালের মতো মহানন্দা পার হলুম। বাকি মহানন্দার বুক থেকে জল সরে গিয়েছে। পায়ে হেঁটেই পার হওয়া গেল। কোন দোকানে গিয়ে ঢুকেছিলুম আর খেয়াল নেই। চৌকো চৌকো, ছোট ছোট করে কাটা খবরের কাগজে করে টেবিলে এল গায়ে দানাদার চাদর জড়ানো রসকদম্ব। পরে লম্বাটে ক্ষীরের গুঁড়ো মাখা কানসাট। রসকদম্ব দু’রকম হয়। একটু শস্তার যেটা তার উপরে ছড়ানো থাকে চিনির দানা। অনেকটা হোমিওপ্যাথিক চিনির গুলির মতো। আর দামী রসকদম্ব গায়ে জড়ায় পোস্তদানা। রসকদম্বের কেন এমন নাম সেটা বোঝা যায়। চিনি বা পোস্তদানা গায়ে জড়ানো থাকে বলে অনেকটা কদমফুলের মতো লাগে। কিন্তু কানসাট কেন? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এটি আসলে বাংলাদেশের মিষ্টি। নবাবগঞ্জ জেলায় কানসাট নামে একটি জায়গায় এর জন্ম। পরে কীভাবে মালদায় ঘাঁটি গড়েছে। কাকতালীয়ভাবে, মালদার মতোই কানসাটেও প্রচুর আম হয়। এবং সেই আমেরও বেশ সুনাম।

মালদা যাতায়াতের সময়েই বর্ধমান স্টেশনে চোখে পড়ত ঠেলাগাড়িতে মৈনাকের মতো বসে থাকা সীতাভোগ-মিহিদানার স্তূপ। কিন্তু কোনও দিন চেখে দেখা হয়নি। প্রথম গালে পড়ল ভাল্কিমাচান বেড়াতে গিয়ে। দ্বিতীয়বারেও ভাল্কিমাচান। প্রথমবার কিছুটা ঠকেছিলুম। ভাল্কী থেকে ফেরার পথে বর্ধমান স্টেশনে নেমেছিলুম। আমরা ক’জন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে কাছাকাছির দোকান থেকে কেনা হয়েছিল মিহিদানা-সীতাভোগ। তার পরে ট্রেনে চাপতেই খবর এল, কোথাকার স্টেশনের কাছে লেভেল ক্রশিংয়ের গেট ভেঙেছে। ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত। তখন পুজোর সময়। কিন্তু বেশ গরম। ট্রেন যত দেরি হচ্ছে ব্যাগে বর্ধমানের দুই প্রসিদ্ধ মিষ্টি তত সেদ্ধ হচ্ছে। সেবার আমাদের সঙ্গে ছিল বন্ধু মিন্টু। ও শ্বশুরবাড়ির জন্যও নিয়েছিল। সেটা কী অবস্থায় কুটুমবাড়ি পৌঁছেছিল সেটা আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আমাদের বাড়ির মিষ্টি প্রায় দম ছেড়ে দিয়েছিল।

এবার পুজোর সময়ে ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’-এর গ্রুপের সদস্যেরা মিলে গিয়েছিলুম। আবার ভাল্কীমাচান। আবার বর্ধমান স্টেশন। এবার আর ভুল করিনি। সহকর্মী আরুণির বাড়ি ওখানে। ওকে ফোন করে জেনে নেওয়া হয়েছিল ভাল দোকানের সন্ধান। গণেশ সুইটসের মিষ্টিগুলো ভালই ছিল। ট্রেনে বসে দীপু, শুভ, বাবলা আর ইন্দ্র মিলে কাড়াকাড়ি শুরু করেছিল। ইন্দ্র ওজনে-আকারে বেশি। দলের অন্যদের দাবি, কাড়াকাড়িতে ও-ই বেশি লাভবান হয়েছে। বাবলা ছোটখাট। মারামারিতে না গিয়ে আঙুল চাটছিল। আমি তো ভয় পেয়ে আমার বাড়ির জ‌ন্য নেওয়া প্যাকেটগুলো কোলে আঁকড়ে ধরে বসেছিলুম।

গ্রুপের প্রথম ভ্রমণ বাঁকুড়া। ২০১৪ সালের দুর্গাপুজোর সপ্তমী থেকে শুরু হয়েছিল বাঁকুড়া চষা। খেয়েছিলুম অনেকরকম মিষ্টি। কোনওটা বেসনের কাঠিভাজা গুড়ের পাকে গোল কিন্তু এবড়োখেবড়ো, কোনওটা লুচির মতো গোল, রসে ডোবানো। কিন্তু আসল মিষ্টিগুলোই বাদ পড়ে গিয়েছিল। পড়ে সহকর্মী সৌরভ এনে খাইয়েছিল মণ্ডা। বেলিয়াতোড়ে যামিনী রায়ের বসতভিটেয় ঢুকেছিলুম প্রায় অভিযান করে। পাঁচিল টপকে। কিন্তু বেলিয়াতোড়ের প্রসিদ্ধ মিষ্টি ম্যাচা চেখে দেখা হয়নি। ম্যাচার জন্য এখনও মনটা মুষড়ে পড়ে।

জনাইয়ে গিয়ে মনোহরা খাওয়া হয়ে গিয়েছে। এই গ্রুপেই সেই অভিযান লেখা হয়েছে। একবার কামারপুকুরে গিয়ে খাওয়া হয়েছিল সাদা বোঁদে। রামকৃষ্ণদেবের প্রিয় বোঁদে। কিন্তু আমাদের দলের কেউ কেউ তেমন পাত্তা দিল না সাদা বোঁদেকে। বরন্তি বেড়াতে যাওয়ার সময়ে আদ্রা স্টেশনে দেখেছিলুম কেকের ঠেলার মেলা। সারি সারি ঠেলাগাড়ির শোকেসে সাজানো কেক। আমাদের দলের ‘টেস্টার’ ইন্দ্রবাবু দেখেই আনচান শুরু করেছিল। আমি রাজি ছিলুমনি। কিন্তু ফেরার সময় রাতে কিনেই ছাড়ল। তারপর এক কামড় খেয়েই থম মেরে বসে রইল। কী হল রে? উত্তর এল, ‘বড্ড বাজে। মুখেরটাই গিলতে পারছি না।’

পরামর্শ দিলুম, ‘ফেলে দে’। উত্তর এল, ‘কেকওয়ালা কটমট করে তাকিয়ে আছে। ফেললে যদি মারে।’

 

*লেখাটি কলকাতার এবেলা পত্রিকার সাংবাদিক দীপক দাসের ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া।